চিকিৎসার অভাবে প্রতি বছর বিশ্বে কী পরিমাণ মানুষ মারা যায় তার একটা পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছিল ব্রিটেন ভিত্তিক ল্যানসেট জার্নাল ২০১৮ সালে। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটিতে দেখা গেছে, কোনো রকম চিকিৎসার অভাবে বিশ্বে প্রতিবছর প্রাণ হারাচ্ছে ৩৬ লাখ মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ভারত, বাংলাদেশ, মধ্য আফ্রিকা ও আফ্রিকায়। শুধু ভারতেই প্রতিবছর ১৬ লাখ মানুষ মারা যায় নিম্নমানের স্বাস্থ্যসেবার কারণে এবং স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে মারা যায় ৮ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ। চীনে প্রতিবছর মারা যায় ৬ লাখ ৩০ হাজার মানুষ। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর মূল কারণটা অর্থনৈতিক। নিরানব্বই ভাগ মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা এক ভাগ ধনী মানুষের এই পুঁজিবাদী বিশ্বে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কয়েকশো বছর আগের মুসলিম সভ্যতায় এর কল্পনাও করা যেত না। যে সভ্যতা মানুষের পরকালীন মুক্তির কথাই শুধু ভাবে নি। তাদের পার্থিব জীবনের অধিকারকেও নিশ্চিত করেছিল।
ওয়াকফ : মুসলিম সভ্যতায় মুক্ত চিকিৎসাব্যবস্থা
ওয়াকফ চিকিৎসা মুসলিম সভ্যতায় সমাজজীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল। পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় থাকতো রাষ্ট্রপরিচালিত বিনা চিকিৎসার হাসপাতাল। এসব হাসপাতাল থেকে সমাজের দুঃস্থ ও গরিব মানুষেরাই সেবা পেত তা নয়। বরং সকলের জন্যই তা ছিল উন্মুক্ত। আসলে চিকিৎসা ও রোগীর শুশ্রূষার প্রেরণাটা ইসলামের মৌলিক শিয়ার ( নিদর্শন) এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এক্ষেত্রে মুসলিম সভ্যতার এমন সব আলোকোজ্জ্বল দিগন্ত উন্মোচিত হয়, যার নজির দ্বিতীয়টি নেই। অসুস্থ রোগীকে দেখতে যাওয়া ও তার সেবা শুশ্রূষাকে ইসলামে মানুষের মৌলিক অধিকার বলে ঘোষণা করেছে। ইসলাম বলেছে, যে মুসলিম সকালবেলা কোনো রোগীর সেবা-শশ্রুষা করে, ৭০ হাজার ফেরেশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত তার জন্য দোয়া করতে থাকে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যাবেলা শ্রশ্রুষা করতে যায়, সকাল পর্যন্ত সত্তর হাজার ফেরেশতা দোয়া করতে থাকে এবং জান্নাতে তাকে একটি বাগান দেওয়া হয়।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৯৬৯)
মুক্ত চিকিৎসায় ধর্মীয় অনুপ্রেরণা
মানবসেবায় ইসলামের এ প্রেরণা থেকেই দেখা যেত, মুসলিম শাসনামলে শহর ও মহল্লাগুলোতে মসজিদগুলোর সাথে একটা করে ফার্মেসিও থাকতো। বিভিন্ন বড় বড় মসজিদ ও জনবহুল স্থানে বসানো হত ভ্রাম্যমান চিকিৎসাকেন্দ্র। এ ধরনের ভ্রাম্যমান হাসপাতালের পাশাপাশি নির্মিত ছিল বড় বড় হাসপাতাল। সেখান থেকে রোগীদেরকে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করা হত। সমাজের নেতৃস্থানীয় লোক ও ধনীব্যক্তিরা অসহায় মানুষদের সেবার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য এগুলো প্রতিষ্ঠা করতেন।
সুলতান নূরুদ্দীন রাহ. ৫৪৯ হিজরীতে প্রতিষ্ঠা করেন ‘আলমুসতাশফান নূরী আলকাবীর’। দামেশকে নির্মিত এ হাসপাতালটি ছিল তৎকালীন দেশের সবচেয়ে সুন্দর হাসপাতাল। হাসপাতালটিকে কেবলমাত্র গরীব ও অসহায় ব্যক্তিদের জন্য তিনি ওয়াকফ করেছিলেন। তবে হাঁ, প্রয়োজনে ধনীরাও সেখানে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারত। রোগীদের সব ধরনের ঔষধ-পত্র হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে প্রদান করা হত।
৬৮৩ হিজরীতে আলমালিকুল মানসূর সাইফুদ্দীন নির্মাণ করেন ‘আলমুসতাশফাল মানসূরী আলকাবীর’ শৃংখলা ও পরিপাটির দিক থেকে এটি ছিল তৎকালীন যুগের পৃথিবীর সুন্দরতম একটি হাসপাতাল। এর চিকিৎসা সেবাও ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত ও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। প্রত্যেক রোগীর সেবায় দুজন ব্যক্তি নিযুক্ত থাকত। এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, কেবলমাত্র হাসপাতালে অবস্থানরত ব্যক্তিদেরই চিকিৎসা সেবা প্রদান করত না; বরং যেসকল রোগী হাসপাতালে আসতে অক্ষম তাদের বাড়ী গিয়ে সেবা প্রদান করা হত এবং প্রয়োজনীয় ঔষধ ও খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হত। প্রতিদিন প্রায় চার হাজার মানুষকে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হত এ হাসপাতাল থেকে। যারা সেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে উঠত, যাওয়ার সময় পরিধান করার জন্য তাদের একটি করে নতুন কাপড় দেয়া হত এবং ঘরে ফিরে অতিরিক্ত পরিশ্রমসাধ্য কাজ করে স্বাস্থ্যের যেন অবনতি না ঘটে এজন্য প্রয়োজন পরিমাণ অর্থও দিয়ে দেয়া হত। -মিন রাওয়াইয়ি হাযারাতিনা, পৃ. ২১২
চিকিৎসাসেবা : মুসলিমরা কেন এত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন
চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবার খাতটিকে মুসলিমরা কেন এতটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন– এই প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন প্রাচ্যবিদ টমাস ওয়াকার আর্নল্ড তার ‘দ্য প্রিচিং অব ইসলাম’ বইয়ে। বইয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন, মুসলিমরা এ খাতটি শুধু মানবসেবা নয়, বরং একই সাথে দীনী দাওয়াতের উপায় হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। যার ফলে মুসলিম দাঈদের কোন রকম প্রচার সংগঠন ও মিশনারী ছাড়া এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার প্রতিটি জনপদে পৌঁছে গেছে ইসলাম। আর্নল্ডের মতে মুসলিম দাঈদের সেবা, ত্রাণ আর দাতব্য সংস্থার বদৌলতে মানুষের হৃদয়ে সহজেই আসন গেড়ে বসত ইসলাম। একদিকে তারা মানুষকে সাহায্য করতেন ক্ষুধায় খাদ্য দিয়ে , শীতে বস্ত্র দিয়ে এবং রোগ ব্যাধিতে চিকিৎসা আর শুশ্রূষা করে। অন্যদিকে তাদের পূতঃচরিত্র, শুদ্ধ আচরণ ও উচ্চারণ এবং ঐশী বাণীর মোহময়তায় মানুষ দলে দলে দাখিল হত ইসলামে।
প্রাচ্যবিদ টমাস ওয়াকার আর্নল্ডের এ বই এখন সারা পৃথিবীর মিশনারী কলেজের পাঠ্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হবে মিশনারীগুলো যেন এ বইয়ে আলোচিত মুসলিম দাঈদের মানবসেবার প্রতিটি পদরেখা অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করে চলেছে। বলাবাহুল্য, আজকের পৃথিবীতে তথাকথিত যেসব আন্তর্জাতিক চিকিৎসা ও দাতব্য সংস্থা আছে, সেগুলোর প্রেরণা ইসলাম থেকেই নেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে সভ্যতার জন্মদাতা মুসলিমরাই আজ বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব বরণ করে নিয়েছে।
আমরা কী করতে পারি
পূর্বপুরুষের পথ ধরে দুঃস্থ ও অসমর্থ মানুষের চিকিৎসার্থে মুক্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা যদি আমরা গড়ে তুলতে পারি, সেটাই হবে মানবতাবোধ। ইসলাম তো মানবতারই ধর্ম। বর্তমান মুসলিম বিশ্বে এরকম অনেক দাতব্য ও স্বাস্থ্যসংস্থা আছে, যারা বিভিন্ন দেশে মুক্ত চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকে। তুরস্কের টিআইকেএ, দিয়ানাত ফাউন্ডেশন, আরব কয়েকটি দেশের রেড ক্রিসেন্ট সহ অনেক দেশেই আছে এ রকম ব্যবস্থাপনা। তদ্রূপ আমরাও সরকারি, আধা সরকারি কিংবা সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগেও গড়ে তুলতে পারি।
আসলে কথা হচ্ছে, জনসেবা ও মানবতাবোধের যে শক্ত পাটাতনের উপর ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতার ভিত্তিটা গড়ে ওঠেছিল তা যেন আমরা ভুলেই গেছি। পতনের এই যুগে আমরা যদি সত্যিকার অর্থেই আবার ওঠে দাঁড়াতে চাই, ঘুরে দাঁড়াতে চাই, তাহলে সৃষ্টির সেবার এই মহান ব্রতকে ভুলে থাকার কোন অবকাশ নেই।