১৯৯১ সালের কথা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলো মাত্র।
পতনের মুহূর্তেই মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের ইঙ্গিতে একটি বই লিখলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকোয়ামা। বইয়ের নাম দিলেন ‘দি এন্ড অব হিস্ট্রি অ্যান্ড দ্য লাস্ট মেন’। বইতে তিনি চ্যালেঞ্জ করলেন, অনাগত কাল পর্যন্ত আমেরিকার সভ্যতা সংস্কৃতি সারা পৃথিবীর অনুসরণীয় একমাত্র আদর্শ হিসেবে টিকে থাকবে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত শক্তিশালী কোনো আদর্শ বর্তমান পৃথিবীতে অবশিষ্ট নেই! কী সমাজতন্ত্র, কী ইসলাম — কোনো ইজম আর ধর্মই পশ্চিমা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার মতো প্রাণশক্তি ও গতিশীলতা রাখে না।
ফ্রান্সিসের সেই বই স্বভাবতই চরম সাড়া ফেলে বাজারে। পৃথিবীর দেশে দেশে প্রকাশ হতে থাকে এর নানা সংস্করণ, নানা ভাষায়। কিন্তু এর প্রতিবাদ আসে না কোথাও থেকে। পেরিয়ে যায় পুরো একটি বছর।
তারপর ১৯৯২ সালে প্রথম ওই বইয়ের জবাবে বাজারে আসে একটি বই। নাম ‘ইসলাম দি অল্টারনেটিভ’। বইয়ের লেখক আর কেউ নন, খোদ পশ্চিমের দানাপানিতে পুষ্ট হওয়া জার্মান ডিপ্লোমেট ড. মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান। পাশ্চাত্যের শিক্ষা সংস্কৃতিতে বড় হওয়া ড. মুরাদ যেন খোদ পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। ওই বইতে তিনি পশ্চিমা সংস্কৃতিকে এমন বুদ্ধিবৃত্তি আর যুক্তির ভাষায় তুলোধুনো করেন, যার নজির পাশ্চাত্য আর কখনো দেখেনি।
বইয়ে গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে ড. মুরাদ বলেছেন, ইতিহাস শেষ হয়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই আসে না এবং চাইলেই কেউ ইতিহাসের গতি থামিয়ে দিতে পারবে না। যদি না স্বয়ং আল্লাহ তাআলা সেটা চান। তার মতে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এখন পুঁজিবাদী দর্শনের ভাটার টান শুরু হয়ে গেছে এবং বিশ্বব্যবস্থার মূলে ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করার সময় এসেছে। সুতরাং ইতিহাস শেষ হয়ে গেছে বলে যে ঢোল পিটানো হচ্ছে পশ্চিমা জগতে , তা নিছক বাগাড়ম্বর ছাড়া কিচ্ছু নয়।
ড. মুরাদ জার্মানির নাগরিক ছিলেন। এক ক্যাথলিক খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম তার। পড়াশোনা করেছেন মিউনিখ আর নিউইয়র্কের বিভিন্ন ভার্সিটিতে আইনের ওপর। লাভ করেছেন ডক্টরেট ডিগ্রি। কর্মজীবনে বিভিন্ন দেশে জার্মানির রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। দীর্ঘ তিন যুগের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন দেশের সভ্যতা সংস্কৃতিকে পর্যবেক্ষণ করে অবশেষে দীক্ষিত হন ইসলামে। তখন তিনি আলজেরিয়ায় নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত।
কাছ থেকে পাশ্চাত্যের সভ্যতা সংস্কৃতির মিথ্যা খোলস আর ভণ্ডামিকে অবলোকন করা মুরাদ নিজেই জানিয়েছেন, তার এ জবাবি বই প্রকাশের সাথে সাথেই জার্মান মিডিয়া এর উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং সেই পুরনো ইউরোপীয় কৌশলে তাকে মৌলবাদী, নারীবিদ্বেষী, মধ্যযুগীয় ব্যবস্থার সমর্থক ইত্যাদি বলে গালি দিতে শুরু করে। এবং এ কারণে তাকে রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে বহিষ্কার করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব গালিগালাজ, তিরস্কার, বহিষ্কার এমনকি হুমকি ধমকি সব উপেক্ষা করে তার এ বই বিগত কয়েক দশক ধরে পাশ্চাত্য জগতে ইসলামের পক্ষে শক্ত ওকালতি করে আসছে।
ফলত: মুরাদ হফম্যানকে পাশ্চাত্যে ইসলামের অন্যতম শক্তিমান উকিল বলা চলে। তার বই বাদ দিলে পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক পড়াশোনা অপূর্ণ থেকে যায়। মুরাদ হফম্যান তাই অবশ্যপাঠ্য। বিশেষত সভ্যতা ও ইতিহাসের যারা ছাত্র, তাদের জন্য।
মুরাদ হফম্যানের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই:
১. রিলিজিয়ন অন দ্য রাইজ
২. ইসলাম অ্যান্ড কুরআন
৩. জার্নি টু মক্কা
৪. জার্নি টু ইসলাম
৫. ইসলাম ২০০০
৬. দার ইসলাম
৭. দার কুরআন
৮. ইসলামিক ফিলোসোফি।