পড়ছিলাম মহান গাযালিকে নিয়ে। উম্মাহর জ্ঞানভাণ্ডারে যে মুক্তো প্রবাল তিনি রেখে গেছেন সেসবের পরিচয় নিয়ে। এই উম্মাহর জন্য ইমাম গাযালি কী করে গেছেন, তা বুঝতে হলে তার সময়ের মুসলিম জাহানের চিন্তাগত নৈরাজ্যকে বুঝতে হবে। ইসলামের বিস্তার হয়েছিলো দ্রুত। উদ্ভবের মাত্র একশত বছরের মধ্যেই সমগ্র আরব উপদ্বীপ, উত্তর আফ্রিকা, এশিয়া মাইনর, মধ্য এশিয়া, স্পেন, সিন্ধু ইত্যাদি মুসলিম অধিকারে আসে। জেরোস্টার, মাজদাক, বুদ্ধিস্ট ইত্যাদি ভাবধারার লোকেরাও ইসলামের ছায়াতলে আসে। যরথ্রুস্ট্রিয় ভাবধারার বাহক পারসিক, গ্রীক ভাবধারার বাহক সিরিয়ান, বিচিত্র কূটচিন্তার বাহক ইহুদি এবং মধ্যযুগীয় ঘোর কুসংস্কারে ডুবন্ত বহু খ্রিস্টান ইসলাম গ্রহণ করে। এদের অনেকেই জাগতিক সুবিধার জন্য কিংবা বিজয়ী জাতির সাথে থাকার জন্য নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দিতো। কিন্তু অন্তর ছিলো খাঁটি ইসলামদ্রোহী। খ্রিস্টান পাদ্রী, ইহুদী পণ্ডিত, বাইজেন্টাইন তাত্ত্বিক, পরাজিত পার্সিয়ানদের অনেকেই ইসলামী চিন্তাধারার মধ্যে বিকৃতি আনার প্রতিযোগিতা শুরু করে। এরা সকলেই ছিলো যিন্দিক। সরলচিত্ত মানুষদেরকে এরা বিভ্রান্ত করে। অসংখ্য নয়া মতবাদ ও ভাবধারা ছড়িয়ে দেয়, বিদআতের প্রচলন ঘটায়। এ প্রেক্ষাপটের সন্তান মুতাজিলা মতবাদ। মুতাজিলারা ছিলো একটি দার্শনিক সম্প্রদায়। ৭৪৮ বা ৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণকারী ওয়াসিল ইবনে আতা ছিলো এর প্রতিষ্ঠাতা। এরা সেকালের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের উপর ভর করে দার্শনিক সিদ্ধান্ত এবং যুক্তিবাদ দিয়ে ইসলামকে ব্যাখ্যা করতো। (তখনকার বৈজ্ঞানিক তথ্য ও যুক্তিবাদের অধিকাংশই ছিলো ভ্রান্ত ও হাস্যকর। বিজ্ঞানই পরবর্তিতে একে হাস্যকর সাব্যস্ত করেছে। ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে)
ইসলামের প্রতিটি বিশ্বাসকে তারা যুক্তি দিয়ে প্রতিপন্ন করতে চাইতো। তাদের যুক্তিবাদ ছিলো নব্যপ্লেটোবাদ ও গ্রীক যুক্তিধারার অনুরূপ। কুরআন-হাদীসের সব কিছুতেই যুক্তিই ছিলো তাদের প্রথম ও প্রধান প্রমাণ। তাদের যুক্তিতে যা প্রমাণ হয় না, কুরআন দ্বারা তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত হলেও একে তারা বর্জন করতো। এভাবে ইসলামের অসংখ্য বিষয়কে হয় প্রত্যাখান, নয় বিকৃত করে তারা। তারা বলতো, যুক্তিতে প্রমাণ করা যায় বলেই আল্লাহ তায়ালার অস্তিত্ব স্বীকার করা যায়। প্রমাণ করা না গেলে স্বীকার করা যেতো না। তাদের এই যুক্তিপূজা মহামারির মতো মুসলিম জাহানে ছড়াতে থাকে।
তাদের মোকাবেলায় প্রথম আওয়াজ তোলেন ইমাম আবুল হাসান আশআরী (ইন্তেকাল-৯৩৫ খ্রি.)। তিনি ছিলেন দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ। তিনি প্রতিবাদের একটি ধারা তৈরী করেন। যা মুতাজিলাদের থাবা থেকে মুসলিম চিন্তাজগতকে রক্ষা করার একটি দুর্গ ও আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। তার চিন্তাকে অবলম্বন করে বিকশিত হন স্কলাসটিকা ধর্মতত্ত্ববিদগণ। ধর্মতত্ত্ববিদদের সেই কাফেলায় সরদারের আসনে যিনি ছিলেন তিনি হলেন ইমাম গাযালি।
দুই
ইসলামের বিরুদ্ধে ধর্মের আড়ালে চিন্তার যুদ্ধে সবচে ভয়ংকর ভাবে লেগেছিল যে শিবিরটি, তার নাম বাতেনি সম্প্রদায়। ইসলামের হৃত সাম্রাজ্য ও শাসনক্ষমতা হারানো জাতির লোকেরা ছিলো এ মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা। তারা তরবারি দিয়ে ইসলামকে প্রতিহত করার সকল চেষ্টা করেছে। বার বার বিদ্রোহ করেছে, রক্ত ঝরিয়েছে। কিন্তু অবশেষে যখন ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ফিরে পাবার আশা হারিয়েছে, মুসলিম হবার ভান করেছে।
তাদের চিন্তা-চেতনায় বদ্ধমূল ছিলো প্রকৃতিপূজা, যরথ্রুস্টবাদ ও পারসিক জাতিবাদ। অমুসলিম অবস্থায় তারা ইসলামকে শেষ করতে চেয়েও পারেনি। এবার তারা মুসলিম হয়ে সেই কাজ করতে চাইলো। তারা হাতে নিলো ভয়ানক কৌশল। তারা শরীয়তের গোটা কাঠামোকে চাইলো বদলে দিতে। শরিয়তের নীতিমালা, আকাইদ, হুকুম আহকাম ও আইন-কানুন যে সব পরিভাষার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। সে সব পরিভাষাকে তারা পরিবর্তন করে দিলো। যে সব শব্দে দীন উপস্থাপিত হয়েছে, এর অর্থ-মর্মসহ সব কিছুর ব্যাখ্যা করেছেন নবীজি সা. এবং আপন আমলে তার বাস্তব নমুনাও দেখিয়েছেন। যা ইসলামের আকিদা ও ব্যবহারিক রূপ। কিন্তু যদি এর অর্থ ও মর্মকে রাসূল সা. নির্দেশিত অর্থ ও মর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়, তখন ইসলাম আর ইসলাম থাকে না। যেমন, ঈমান, নবুওয়াত, রিসালাত, ওহী, আখেরাত, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, হালাল -হারাম,ফরজ-ওয়াজিব ইত্যাদি।
বাতেনীরা প্রচার করলো, ইসলামের প্রতিটি বিষয়ে প্রতিটি শব্দের একটি অর্থ প্রকাশ্য, যা মূল অর্থ নয়, আরেকটি অর্থ গোপন, যা সত্যিকার ও যথার্থ । শুনুন মুহাম্মদ ইবনে হাসান দায়লামী তার ‘কাওয়াইদু আকাইদে আলে মুহাম্মদ’ নামক কিতাবে কী লিখেছে—
“নবী সেই শক্তির নাম যার ওপর কুদসিয়া সাফিয়া শক্তির ফয়েয বর্ষিত হয়েছে। জিবরীল কোন সত্তার নাম নয়, শুধু ফয়েযের নাম। ‘জানাবত’ বলতে বোঝায় রহস্যের প্রকাশ। ‘গোসল’ দ্বারা বোঝায় অঙ্গীকারের পুনরুজ্জীবন বা নবায়ন। ‘যিনা’ (ব্যভিচার) বলতে বোঝায় ইলমে বাতেনের বীজকে এমন কোন সত্তার দিকে স্থানান্তরিত করা যে অঙ্গীকারে শরিক নয়। ‘তাহারাত’ তথা পবিত্রতা বলতে বোঝায় বাতেনিয়া মাজহাব ভিন্ন প্রতিটি মাজহাব থেকে মুক্তি লাভ। ‘তায়াম্মুম’ অর্থ এজাযতপ্রাপ্ত ব্যক্তি থেকে ইলম হাসিল। ‘সালাত’ দ্বারা বোঝায় যুগের ইমামের দিকে আহ্বান। ‘যাকাত’ বলতে বোঝায় যোগ্য ব্যক্তি ও সূফির ভিতর আলমের প্রচার। ‘রোযা’ বলতে বোঝায় গুপ্ত রহস্য প্রকাশ থেকে পরহেজ করা ও সতর্কতা অবলম্বন করা। ‘হজে’র অর্থ সেই জ্ঞান অন্বেষণ করা যা আকল বলা বুদ্ধির কেবলা বা মনযিলে মাকসুদ। ‘জান্নাত’ বলতে ইলমে বাতেন ও ‘জাহান্নাম’ বলতে ইলমে জাকিরকে বোঝায়। ‘কাবা’ বলতে খোদ নবীর সত্তা এবং কাবার দরজা বলতে আলী রা. কে বোঝায়।”
এ পরিস্থিতিতে ইমাম গাযালি বাতেনি মতবাদকে নিবিড়ভাবে বোঝার জন্য বিপুল অধ্যয়ন শুরু করলেন। তিনি লিখেছেন, বাতেনি মতবাদকে আয়ত্তে আনার জন্য আমি নিজেই এই মতবাদের ছাত্র হয়ে গেলাম। ইমাম গাযালি বাতেনিদের ভেতর বাইরকে অনুধাবন করলেন। তারপর খলিফা মুস্তাযহির বিল্লাহ তাকে আদেশ করেন বাতেনিদের প্রতিরোধে একটি শক্তিশালী গ্রন্থ রচনার জন্য। গাযালি বলেন, রাজার আদেশের চেয়ে বরং ভেতরের প্রেরণাতেই আমি বইটির রচনা সম্পন্ন করলাম। এ বইটির নাম ছিলো ‘কিতাবুল মুস্তাযহিরী’। বইটিতে বাতেনিদের প্রতিটি বিভ্রান্তির অপনোদন রয়েছে। অত্যন্ত শক্তিশালী ভাষাভঙ্গি ও যুক্তি কৌশলে গাযালি তাদেরকে রদ করেন। ফলে বাতেনি ফেরকার তাত্ত্বিক বুনিয়াদ অনেকটা চুরমার হয়ে গেল। তারা আর আগের শক্তিতে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে নি।
তিন
দুটি প্রধান ও পরাক্রান্ত ঝড়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন ইমাম গাযালি। একটি ছিলো দার্শনিক ও যুক্তিবাদী, যার কেন্দ্রে ছিলো গ্রীক দর্শন। অপরটি ধর্মতাত্ত্বিক ও গূহ্যবাদী,যার কেন্দ্রে ছিলো বাতেনি মতবাদ।
গাযালি শক্তহাতে এসব ফেতনার প্রতিরোধই শুধু করেন নি, আরো অগ্রসর হয়ে এসবের ভিত্তিমূলকে উপড়ে ফেলেছিলেন। মোটকথা সে সময়ে যখন দর্শন ও বাতেনি চিন্তাধারা বিপুলভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল, তখন মুতাকাল্লিমগণ ইসলামের আকিদা বিশ্বাসের পক্ষে ওকালতি করছিলেন। এবং ইলমে কালাম সেসব ধাক্কার মুখে প্রতিরোধের প্রাচীর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিলো। কিন্তু এ সবই ছিলো আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা। এ দিয়ে তার প্রতাপ ও সয়লাবকে থামানো কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না। আগে বেড়ে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করার মতো কেউ ছিলেন না। এক্ষেত্রে ইমাম গাযালী প্রথম ব্যক্তি, যিনি একেবারে দর্শনের মূল গোড়ায় কঠিন আক্রমণাত্মক আঘাত করেছিলেন। আর এখানেই এসে স্পষ্ট হয়, একজন দার্শনিক কীভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক তুফানের মোকাবেলা করে সাদ্দে সেকান্দারির মতো আগলে রাখেন উদ্ভ্রান্ত চিন্তাধারার প্লাবনে নড়বড়ে উম্মাহর চিন্তাদর্শন ও আকিদা ফালসাফাকে।









