না কাব্য, না গদ্য, না কোনো শাস্ত্র। আল-কুরআন নিছকই আল-কুরআন। ধর্মতাত্ত্বিকের জন্য ধর্মীয় বিধান, প্রজ্ঞা, নির্দেশনা ও আধ্যাত্মিক শিক্ষার এক পৃথিবী, বিজ্ঞানীদের জন্য বিজ্ঞানের এক বিদ্যায়তন, শব্দ ব্যুৎপত্তিতে দক্ষ পণ্ডিতদের জন্য এক অভিধান, ব্যাকরণবিদদের জন্য ব্যাকরণের এক বুনিয়াদ, কবিদের জন্য শব্দ ও অর্থালঙ্কারের বর্ণিল আকাশ, নীতিশাস্ত্রবিদদের জন্য নীতিবিদ্যার আকর-উৎস আল-কুরআন। ঐতিহাসিক, শাসক ও বুদ্ধিজীবীদের কাছে এর গুরুত্ব এনসাইক্লোপিডিয়ার চেয়েও বহুগুণ বেশি, আইন প্রণয়নের বিধিমালার বিশাল ভিত্তিকোষ, দার্শনিকের জন্য দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টির বিপুল ভাণ্ডার।
কিন্তু আল-কুরআন সুনির্দিষ্টভাবে কোনো বিষয়েরই একক গ্রন্থ নয়। কুরআন একসময় মানুষকে বিস্মিত করে, এরপর সম্মোহিত করে এবং সবশেষে অদ্ভুত এক মনোতরঙ্গে তাকে সন্তরণ করায়। মৃন্ময় ও সাধারণ সৌন্দর্যতাত্ত্বিক আদর্শের বিচারে এ গ্রন্থের সাহিত্যিক ও দার্শনিক উৎকর্ষ নির্ণয় করা সম্ভব নয়। এ হচ্ছে মানবজাতির জন্য আল্লাহর হেদায়েত।
হেদায়েতের এই মহাগ্রন্থ মানবজীবনকে সব পথে, সব উপায়ে, সব মাত্রায় আলিঙ্গন করে, নিকষিত, বিকশিত ও বিভূষিত করে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মানবজাতির সব কর্মকাণ্ডের জন্য সুস্পষ্ট পথ প্রদর্শন করে। মানবতার মুক্তি ও কল্যাণের জন্য এর বাণীসমূহ যেকোনো দর্শন ও তত্ত্বজ্ঞানের চেয়ে অধিক আবেদন ও অর্থময়, অধিক মহিমামণ্ডিত। এর প্রতিটি অক্ষর ও শব্দ মহান আল্লাহর বড়ত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব ও স্তুতির পবিত্রতার প্রকাশক। ফলে তাকে দার্শনিক বিষয়াবলির বিন্যস্ত অবয়বে প্রত্যক্ষ করার আকাক্সক্ষা যেমন যথার্থ নয়, তেমনি তার অন্তর্দৃষ্টিসমূহ বাদ দিয়ে দার্শনিক জিজ্ঞাসাগুলোর মীমাংসা করা হবে, এটিও আত্মঘাতী। ফলে আমাদের দেখতে হবে আল-কুরআনে জীবনের দার্শনিক প্রসঙ্গগুলো কীভাবে বিবৃত ও প্রতিফলিত হয়েছে। আর জীবনের কাছে তার বার্তা কী, আবেদন কী!
আল-কুরআনে দার্শনিক যে মুখ্য ও অবধারিত প্রশ্নগুলোর সুরাহা বাঙময়, তার মধ্যে রয়েছে চারটি কেন্দ্রীয় প্রসঙ্গ। সেগুলো হচ্ছে- ১. মানুষ কী ও কেন, এই প্রশ্নের জবাব। তার পরিচয় ও সংজ্ঞা এবং বিশ্বব্যবস্থায় তার অবস্থান ও ভূমিকা কী, সেটি স্পষ্টকরণ। এখানে তার পদমর্যাদা ও দায়িত্বের প্রশ্নের কুরআনি সুরাহা; ২. মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক, পরিবার ও সমাজে মানুষের ভূমিকা ও এর ভিত্তি। সম্মিলিত জীবনে মানুষের পারস্পরিক দায়িত্ব ও ব্যক্তি মানুষের করণীয়; ৩. অপরাপর প্রাণ ও প্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্ক, সৃষ্টিজগতে তার ভূমিকার ভিত্তি এবং বস্তুজগত ব্যবহারে তার অধিকার, দায় ও দায়িত্ব; ৪. মানুষ, অপরাপর সৃষ্টি ও প্রকৃতির সাথে এর স্রষ্টার সম্পর্কসূত্র। এখানে মানুষের পরিচিতি ও ভূমিকা এবং স্রষ্টার আনুগত্যের দায় ও দায়িত্ব।
কুরআনের আলোচনায় এসেছে জীবন, জগত, জ্ঞান, মূল্যতত্ত্ব, যৌক্তিকতা, মূল্যবোধ, জড়, প্রাণ, মন, স্রষ্টার অস্তিত্ব ও নিখিলে তার কর্ম ও এর প্রকাশ। মানুষের অভিজ্ঞতার প্রতিটি দিকের প্রতি আপন আদলে মনোযোগ দিয়েছে আল-কুরআন। দর্শন ও মানব অভিজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞানের প্রতিটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করে। দার্শনিক মনোযোগ ও আলোচনাসীমায় বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, মৌলিক ও অবধারিত। এসব বিষয়কে সাধারণত পাঁচটি স্তরে ভাগ করা হয়। যেমন-
১. বিশ্বতত্ত্ব (Cosmology)
২. তত্ত্ববিদ্যা (Ontology)
৩. মনোদর্শন (Philosophy of mind)
৪. জ্ঞানবিদ্যা (Epistemology)
৫. মূল্যবিদ্যা বা মূল্যসম্পর্কীয় দর্শন (Axiology)
আল-কুরআনে আমরা দেখি, এসব আলোচ্য বিষয় নানাভাবে হাজির হয়েছে। এই হাজিরি ঘটেছে কুরআনের এজাজ বা অলৌকিক বৈশিষ্ট্যসহকারে, একেবারে নিজের মতো করে, দার্শনিকদের মতো করে নয়।
কুরআন সব বিষয়ে আলোকপাত করে এক কেন্দ্রীয় সত্যের আওতায়। ফলে তাতে হাজির হওয়া বিষয়ের একটি আরেকটি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে না, দূরবর্তী হয় না। সব বিভিন্নতা এখানে পরস্পরলগ্ন। আল্লাহর পরিচয় ও তার সাথে সম্পর্ক এখানে এমন এক কেন্দ্রীয় বন্ধনসূত্র, যা সব কিছুকে পরস্পরের সাথে যুক্ত করে, লগ্ন করে এবং চরিত্রদান করে। জীব, জড়, চিন্তা, কর্ম, যুক্তি, ভাব, ব্যক্তির আত্ম-পর, আত্মচেতনা, সমাজচেতনা, বিশ্বলোকভাবনা ইত্যাদিকে আল-কুরআন একটি যৌথ শৃঙ্খলায় প্রতিস্থাপন করে, যার চরিত্র ঠিক করে দেয় ফিতরাত বা স্বভাবগত স্বাভাবিকতা। কুরআনের ভাষায় এই জীবনপন্থা সব স্বাভাবিকতাকে ধারণ করে সরল, সহজ, যথাযথ ও যথোচিত ভাবাদর্শ ও কর্মপন্থা হাজির করে, যার নাম সিরাতুল মুস্তাকিম- সহজ-সরল পথ। যা মানুষকে প্রকৃত কল্যাণ, মহাসত্য ও পরম সৌভাগ্য লাভ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।
সিরাতে মুস্তাকিমের তত্ত্বীয় বয়ান ভালো-মন্দের মানদণ্ড, মানবচেতনার বিকাশ ও প্রশিক্ষণের পথনির্দেশ করেই অগ্রসর হয়, তা মানুষের স্বাধীনতা নিয়ে, জগতের নশ্বরতা-অনশ্বরতার মীমাংসা করে, মানুষের অস্তিত্ব ও বিশ্বজগতের স্বরূপ নিয়ে সুনিশ্চয় বক্তব্য উপস্থাপন করে।
এসব বিষয়ে আলাপ করেন দার্শনিকরাও। প্রাচীন মিসরীয় দর্শন, ভারতীয় দর্শন, চীনা দর্শন, গ্রিক দর্শন যেমন- এমন বিষয়ে মনোযোগী, তেমনি দর্শনের আধুনিক ও উত্তরাধুনিক পরিক্রমাও এই প্রসঙ্গকে এড়িয়ে পথ চলতে পারেনি, পারবে না। দার্শনিক আলাপ ও অন্তর্দৃষ্টিসমূহ মানুষের চিন্তা ও মনের বিকাশে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব প্রশ্নের জবাবে দর্শনশাস্ত্র বহু মতামতের রণাঙ্গন হয়ে উঠেছে। কোনো ঐকমত্যের সত্যকে আলিঙ্গন করতে পারেনি। এটি এ জন্যই যে, প্রত্যেক দার্শনিকই নিজস্ব দৃষ্টি ও দৃষ্টিকোণের সন্তান। কিন্তু প্রত্যেকের দৃষ্টি ও দৃষ্টিকোণ আলাদা হয়, কোনো দৃষ্টিই সব কিছু একসাথে দেখে না। ফলে কোনো দৃষ্টিকোণেই সব সত্য ও সব বাস্তবতা হাজির থাকে না। এই গরহাজিরির নজির দেখা যাবে দর্শনের পথচলার প্রতিটি ধাপে। প্রত্যেক দার্শনিকের রচনা পরস্পরের সাথে যে বিরোধিতা করে, এই বিরোধিতার ভেতর থেকে যে প্রস্তাবনা বেরিয়ে আসে, তার কোনটি সত্য? কোনো প্রস্তাবনাই সুনিশ্চিত সত্যকে ধরতে পারছে না এবং পরবর্তী দার্শনিক প্রস্তাবনার সামনে প্রত্যাখ্যাত কিংবা নিন্দিত হচ্ছে, আক্রান্ত হচ্ছে। একটি দার্শনিক ভাবধারাকে সমর্থনকারীদের একটি সম্প্রদায় তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে দাঁড়াচ্ছে আরেক সম্প্রদায়।
প্রত্যেকের উচ্চারণে সত্যের ছিটেফোঁটা থাকছে। কেউই পুরোপুরি সত্য বঞ্চিত নন, কেউই সত্যকে আলিঙ্গন করছেন না সামগ্রিক অর্থে। এমনকি সেই দাবিও করতে পারছেন না। এটিই স্বাভাবিক। মানবীয় ইন্দ্রিয়, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা ও স্বজ্ঞা মানুষকে সত্যের সবটুকু দিতে পারে না। যা দেয়, তার মধ্যে থেকে যায় দ্বিধা, সংশয়, অসম্পূর্ণতা। কিন্তু দর্শনের কাজই হলো সত্যকে তালাশ ও অবলম্বন। দ্বিধা, সংশয়, অসম্পূর্ণতা নিয়ে সত্যকে সুনিশ্চয় করতে দার্শনিকরা কত দূর এগোলেন?
জীবন ও জগত নিয়ে দার্শনিকদের বিতর্কগুলো আমরা পড়তে পারি। তারা কি স্রষ্টার পরিচয় সম্পর্কে আমাদের কোনো প্রশান্তিতে প্রবুদ্ধ করতে পেরেছেন? তাদের কাছে স্রষ্টার স্বরূপ কি চরম বিতর্ক জর্জরিত, অসম্পূর্ণ ও অস্বচ্ছ কিছু আইডিয়া নয়, যা প্রতীতিতে পরিণত হতে পারছে না। তাদের কেউ কেউ স্রষ্টাকে অস্বীকার করেছেন। সেই অস্বীকৃতিও সমকালীন ধর্মের সাথে দ্বন্দ্বের ফসল এবং সেখানেও পাওয়া যাবে স্রষ্টার প্রচ্ছন্ন স্বীকৃতি। আবার যে সক্রেটিস স্রষ্টাকে নিখিলের আদি কারণ বলছেন, তিনিই আবার বিশ্বপরিচালনায় তাকে ক্রিয়াহীন বলে ভাবছেন। শুধু প্রথম কারণই তিনি। এরপর তার আর কোনো ভূমিকা নেই। গ্রিক দর্শন স্রষ্টাকে স্বীকার করে আবার করে না। স্বীকৃতিবাদী দর্শন তাকে স্রষ্টা মানে আবার মানে না। যারা স্রষ্টা মানছেন, তারা তাকে জগত ও জীবনের পরিচালক বলে মানেন আবার মানেন না। যারা পরিচালক বলে মানেন, তাদের কাছে তিনি নানা রকম। তার সামগ্রিক পরিচয় ও গুণাবলি অস্পষ্ট, অন্ধকারাচ্ছন্ন এলাকা। যেখানে এক জীবন বিচরণ করা যায়, কিন্তু কোনো স্থির বিশ্বাসের নাগাল মেলে না। মানুষ ও মানুষের পৃথিবীর সাথে তার সম্পর্ক কী, সেটিও অস্পষ্ট, অন্ধকার। মানুষের লক্ষ্য কী, কল্যাণ কোথায়, সুখ ও সাফল্যের স্বরূপ কী, সেটিও কুহেলিকাময় একটি কথামালার দুনিয়া হয়ে রইল।
আধুনিকতার দিশারি দার্শনিক টমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯), ডেকার্তে ( ১৫৯৬-১৬৫০), স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭), জন লক (১৬৩২-১৭০৪), লিবনিজ (১৬৪৬-১৭১৬) প্রমুখের চিন্তাধারা খোদাতত্ত্বে, অধিবিদ্যায়, জ্ঞানতত্ত্বে, মূল্যতত্ত্বে সংশয়, দ্বিধা ও দ্বন্দ্ববিক্ষত চরিত্রকেই বহাল রাখল। অস্থিরতাই তার চরিত্রের প্রধান প্রবণতা হয়ে রইল। যা নতুন শিরোনাম, নতুন চিন্তাপ্রক্রিয়া, নতুন আলোচনা ধারা এবং নতুন তত্ত্বের জোয়ারের মধ্যেও মৌলিক স্বভাব বদলাতে পারল না।
বিচিত্র উপায় ও প্রক্রিয়ায়, বহুমুখী দৃষ্টি ও সৃষ্টিধারায় বিকশিত হয়েছে পরবর্তী দার্শনিক ভাবধারা। কিন্তু জীবন-জিজ্ঞাসার কোনো সদগতি হয়েছে? কয়েক শতকের পশ্চিমা দর্শনে দৃষ্টি দিলে মহিম কিছু নাম সামনে আসবেই। অষ্টাদশ শতকের জর্জ বার্কলি (১৬৮৫-১৭৫৩), ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮), এডমান্ড বার্ক (১৭২৯-১৭৯৭), অগাস্ট কোঁৎ (১৭৯৮-১৮৫৭), ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪), জঁ-জাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮), গেয়র্গ ভিলহেল্ম হেগেল (১৭৭০-১৮৩১), উনিশ শতকের সোরেন কিয়ের্কেগোর (১৮১৩-১৮৫৫), শোপেনহাওয়ার (১৭৮৮-১৮৬০), কার্ল মার্কস (১৮১৮-১৮৮৩), ফ্রিডরিখ নিটশে (১৮৪৪-১৯০০), হার্বার্ট স্পেন্সার (১৮২০-১৯০৩), এমিল মাক্স ভেবার ( ১৮৬৪-১৯২০), বিশ শতকের দার্শনিক লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন (১৮৮৯-১৯৫১), বারট্রান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০), মার্টিন হাইডেগার (১৮৮৯-১৯৭৬), জঁ-পল সার্ত্র (১৯০৫-১৯৮০), জন বোর্ডলি রলস (১৯২১-২০০২), ফ্রেডরিখ অগাস্ট ভন হায়েক (১৮৯৯-১৯৯২), থমাস স্যামুয়েল কুন (১৯২২-১৯৯৬), কার্ল পপার (১৯০২-১৯৯৪), জাক মারি এমিল লাকঁ (১৯০১-১৯৮১), মার্শাল ম্যাকলুহান (১৯১১-১৯৮০) কিংবা জ্যাক দেরিদা (১৯৩০-২০০৪), নোয়াম চমস্কি (১৯২৮-)।
এদের সবারই অর্জন ও অবদান নানা খাতে, নানা স্রোতে, নানা উচ্চতায়। কিন্তু তাদের দার্শনিকতা আমাদের জন্য গ্রিক ও রোমানদের ভাববাদ-বস্তুবাদ, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, খ্রিষ্টীয় উত্তরাধিকার ও ইউরোপীয় রেনেসাঁর ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি থেকে ভিন্ন কোনো আলোকের উদয় কি ঘটায়? এসব দার্শনিক মহান চিন্তা ও অনুভবের প্রদীপ প্রজ্বলিত করেছেন। তাদের চিন্তা ও ভাবধারায় পৃথিবীতে এসেছে বহু পরিবর্তন, বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব। মানুষের বোধ ও বিচার হয়েছে অধিকতর প্রসারিত। বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম। চিন্তাসম্পদে জগতের জ্ঞানভাণ্ডার হয়েছে নানাভাবে ঋদ্ধ। কিন্তু ইন্দ্রিয়াতীত যে সত্য, সেই সত্যের নাগাল তারা পাবেন কোথা থেকে? অথচ সেই সত্যের সহায়তা ছাড়া আমরা আমাদের জীবনের উৎস ও পরিণতিকে ব্যাখ্যা করতে গেলে অনুমান, যুক্তি ও অভিজ্ঞতায় আটকে থাকি। অপূর্ণতায় খাবি খাই। এর ফলে কর্তব্য ও উদ্দেশ্যকেও যথার্থতায় অবলোকন করতে পারি না। সঠিক পথ যদি না থাকে, গন্তব্য অধরা থাকবেই। দৃষ্টিভঙ্গির সঠিকতা যদি না থাকে, সাফল্য ও বিজয়ের সঠিকতা নিশ্চিত হবে না।
ইসলাম তাই সব কালের সব পয়গম্বরের শিক্ষা ও পয়গাম আমাদের সামনে হাজির করেছে। যার সারবস্তু ও চূড়ান্ত উপসংহার হচ্ছে আল-কুরআন। সেখানে মানুষের জ্ঞান লাভের সহজাত উপায়ের স্বীকৃতি রয়েছে। ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, বাস্তব যাচাই-বিশ্লেষণ, জ্ঞানীয় প্রথা-প্রজ্ঞা ইত্যাদিকে অব্যাহতভাবে উদ্বুদ্ধ ও প্রণোদিত করেছে। যা মূলত দার্শনিকদের বিচরণের দুনিয়া। কিন্তু সেই দুনিয়ার উপরে কাশফ বা অন্তর্চক্ষু উন্মোচন, ইলহাম বা অন্তরে অবতরণকৃত অভিজ্ঞান, মুশাহাদা বা আধ্যাত্মিক প্রত্যক্ষণের মতো স্তরও নির্দেশ করেছে। এর মাধ্যমে অতীন্দ্রিয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জিত হয়। কিন্তু এগুলোও সংশয়ের ঊর্ধ্বে নয়।
সংশয়ের ঊর্ধ্বে যে সুনিশ্চয় সত্য, সে হচ্ছে ওহি। আল-কুরআন সেই ওহির অবিকৃত ও সর্বশেষ, চূড়ান্ত হেদায়েত। যা জীবন ও জগতকে বিচারের এমন পথনির্দেশ করে, যা জগত সৃষ্টি ও এর পরিচালনাকে উদ্দেশ্যমূলক শৃঙ্খলা হিসেবে উপস্থাপন করে। এর সব উপাদান এবং বস্তু-অবস্তুকে বিচারের সব মাত্রাকে স্বীকার করেও একটি বিশ্বাসজাত ও উদ্দেশ্যমুখী অন্তর্দৃষ্টি উপস্থাপন করে। মানুষের জন্ম, বেড়ে ওঠা, জীবনপরিক্রমা ইত্যাদিকে সেই সমন্বিত লক্ষ্যের চালকে পরিণত করে। এর মধ্য দিয়ে জীবন ও জগত সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট, অসংশয় দৃষ্টিভঙ্গি হাজির হয়। যা প্রাকৃতিক সহজতা ও স্বাভাবিকতার মতোই অমোঘ, সরল ও অবধারিত।
দার্শনিকদের জীবন ভাবনা, জীবন বিচার ও জীবন-অধ্যয়নকে আল-কুরআনের ওহিভিত্তিক সেই জীবনবাদের মুখোমুখি করা এমন এক কাজ, যা বিশ্বাসী ও চিন্তাশীল মানুষের জন্য যেমন জরুরি, তেমনি অবিশ্বাসীদের জন্যও এই প্রজ্ঞার প্রয়োজন রয়েছে।
লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com