ইটালিয়ান ভাষায় প্রবাদ আছে– কগিটো এর্গো সাম। এর ইংরেজি দাঁড়ায়, I think therefore i am, অর্থাৎ, আমি চিন্তা করি, তাই আমি বাঁচি। তাহলে কি চিন্তা করাটাই মানুষের বেঁচে থাকার উপাদান? পশ্চিমা দর্শন ও চিন্তারাজ্যে এই প্রবাদের নিবিড় প্রভাব রয়েছে। মানুষের যে নিজস্ব সত্ত্বা সে খাচ্ছে বলে, ঘুমাচ্ছে বলে, সংসার করছে বলে গড়ে ওঠছে,এমন নয়। খাবার-দাবার, ঘুম জাগরণ, পরিবার- সমাজ, প্রজনন এগুলো দিয়েই মানুষ নয়। এগুলোতেই মানুষ হয়ে যাওয়া হয় না। প্রাণীদের মধ্যেও এগুলো আছে যার যার প্রক্রিয়ায়।
ল্যাটিন আমেরিকান এক লেখক অক্টাভিউ পাজ। প্রাণী ও প্রকৃতির সাথে নৈকট্য ছিল তার। ল্যাটিন আমেরিকার মানুষের জীবনযাত্রায় সেখানকার ভূপ্রকৃতির রয়েছে অসাধারণ ভূমিকা। সবখানেই জীবনযাত্রায় ভূপ্রকৃতির বড় একটা ভুমিকা থাকে। ল্যাটিন আমেরিকায় ভূপ্রকৃতির কেন্দ্রে আছে অ্যামাজন নদী। সেটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদী। তার অনুদানে গড়ে ওঠা অ্যামাজন বন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জঙ্গলও। ৭০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের জঙ্গল এটি। ৯ টি দেশজুড়ে তার বিস্তৃতি। ৩৯০ মিলিয়ন বৃক্ষ আছে এই বনে। হাজার হাজার প্রজাতির পাখি, মাছ এবং স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ ও উভচর প্রাণী সেখানে আছে। সেখানকার জীবনের সাথে প্রাণীদের সংযোগ খুব নিবিড়। অক্টাভিউ পাজ দূর থেকে সেই বন্ধনের একজন পর্যবেক্ষক ছিলেন। তিনি বলতেন, অরণ্যে বানরেরা পারিবারিকভাবে একত্র হয়ে খায়। মানুষেরা সেই খাবারের দৃশ্য ভিডিও করে, ছবি তোলে, উপভোগ করে। কিন্তু মানুষ যেভাবে খায়, সেটা যদি বানরেরা, সিংহেরা, মাছেরা কিংবা পাখিরা ভিডিও করতে পারত, তারাও এই খাবারের ছবি নিয়ে, ভিডিও নিয়ে বিনোদন পেতে পারতো। মোটকথা মানুষের সাথে প্রাণীদের জৈবিক ব্যাপারাদিতে খুব গুরুতর কোন পার্থক্য নেই। মানুষকে বিশেষত্ব দিয়েছে তার চিন্তা করার শক্তি। মানুষের চিন্তার পরিসর খুবই বিশাল বিস্তৃত। আকাশের অধিক তার প্রসার। মানুষের চিন্তার সঙ্গে আছে তার বিবেক। সুতরাং বিবেক শাসিত যে চিন্তা এবং সে চিন্তাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে যে উদ্ভাবনী, বিশ্লেষণী ও সৃজনশীল ক্ষমতার জাগরণ, সেটা মানুষকে আলাদা করেছে। উচ্চতা দিয়েছে। স্বতন্ত্র করেছে। তার খাবার-দাবার, তার জীবনাচার, তার কাজ কারবারকে শিল্পীত করেছে।
মানুষের মানুষ হওয়ার ইতিহাস আসলে তার বিবেক শাসিত চিন্তা ও সৃজনশীলতার ইতিহাস। অন্য সব বিষয় সহযোগী মাত্র। যেমন মানুষের বলা, চলা ইত্যাদি। তোমরা পড়েছো, মানতেকের কিতাবে মানুষের পরিচয় দেয়া হয়েছে ‘হায়ওয়ানে নাতেক’ বা বলতে পারা প্রাণী বলে। এটি খুবই সংকীর্ণ ও দুর্বল বক্তব্য। নিখিলের সব প্রাণীই বলতে পারে। পাখিরা সংসার করছে, সন্তান জন্ম দিচ্ছে, একই সাথে থাকছে, তারা কি পরস্পরে কথা বলে না? অন্য প্রাণীরা কি বলে না? সকলেই যার যার ভাষায় বলে। কোরআনই তো জানাচ্ছে– আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি সোলায়মানকে পাখির ভাষা শিখিয়েছি। দেখো এই যে বাক্য। এখানে আল্লাহর বলার ধরন। এখানে ‘নুতক’ শব্দটা এসেছে। তার মানে কী? পাখিও হায়ওয়ানে নাতিক–কথা বলতে পারা প্রাণী। আসলে হায়ওয়ানে নাতিক বলে মানুষের প্রকৃত ক্ষমতা কে বুঝানো যায় না। তার নুতক বা বলাকে পথপ্রদর্শন করে তার চিন্তা। এই চিন্তাকে জাগানোর জন্য বারবার আহ্বান করেছে কোরআন।
যারা বিবেকশাসিত চিন্তা করে, আর যারা করে না, যারা জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ভাবতে পারার ইতিবাচক পথকে অবলম্বন করে আর যারা করে না, যারা প্রজ্ঞা ও বিবেককে ব্যবহার করে আর যারা করে না, তাদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলছেন : ‘বল,‘অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান?’
যারা সত্যের জন্য বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগায় না,কোনরূপ চিন্তা করে না,গবেষণা করে না তাদেরকে কুরআনে মূক,বধির,অন্ধ ইত্যাদি অভিধায় তিরস্কৃত করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে :
‘আল্লাহর নিকট নিকৃষ্টতম জীব সেই বধির ও মূক যারা কিছুই উপলব্ধি করে না।’
আরও বলা হয়েছে:
‘আর যে ব্যক্তি এখানে অন্ধ সে আখিরাতেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট।’
যারা সুষ্ঠু ও সদর্থে চিন্তা করে না, তাদের ভর্ৎসনা করে আল্লাহ বলেন, ‘আমি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর আছে, (কিন্তু) তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ আছে, (অথচ) তা দিয়ে তারা দেখে না।’ (সুরা আরাফ : ১৭৯) অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি কোরআন নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করে না, নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’ (সুরা মুহাম্মদ : ২৪) যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধের প্রতি ইসলাম দিয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। দিয়েছে যথাযথ মর্যাদা।
কুরআনের বহু আয়াতে আছে এর বর্ণনা। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদের স্থল ও সমুদ্রের বাহন দিয়েছি, তাদের দিয়েছি উত্তম রিজিক। আর আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের মধ্যে অনেকের ওপর মানুষকে মর্যাদাবান করেছি।’ (সুরা ইসরা, আয়াত ৭০)
আয়াতে কারীমা স্পষ্ট করছে, অন্যান্য সৃষ্টির ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব কেবল বিবেক বা চিন্তাশক্তির কারণেই। অতএব মহাগ্রন্থ আল কোরআন চিন্তা ও গবেষণায় বিবেকবোধকে কার্যকর করার পয়গাম দিয়েছে। অনুভব ও উপলব্ধিকে কাজে লাগাতে বলেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে নবী! বলে দাও, আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে, তার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করো।’ (সুরা ইউনুস, আয়াত ১০১)
প্রকৃতি নিয়ে, সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে, মহাজাগতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভেবে না দেখাকে আল্লাহ তায়ালা তিরস্কার করেছেন। কুরআনের ঘোষণা- ‘তারা কি নিজেদের অন্তরে ভেবে দেখে না, আল্লাহ আসমান ও জমিন এবং এ দুয়ের মধ্যবর্তী সব কিছুই যথাযথভাবে ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সৃষ্টি করেছেন।’ (সুরা রুম, আয়াত: ৮)
পবিত্র কোরআনে বিবেকের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকেও বিবেকের গুরুত্বের কথা অনুধাবন করা যায়। শুধু আকল তথা বিবেক শব্দ থেকে ব্যুৎপন্ন শব্দাবলির ব্যবহার কোরআন মজিদে প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। আর আল্লাহ তাআলার নিদর্শনসহ সম্পূরক বিষয়ে চিন্তা-গবেষণার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে এমন আয়াতের সংখ্যা বিপুল। কোরআনে বিবেকের যথাযথ ব্যবহার করার পাশাপাশি বিবেকের প্রতি জিজ্ঞাসাসূচক বহু বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু পরোক্ষ ইঙ্গিতেই নয়; বরং সব ক্ষেত্রে চিন্তা ও বিবেকের কথা সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ করাহয়েছে। ইসলাম যে মানবিক চিন্তা ও বিবেককে মূল্যায়ন করেছে, তার জন্য তো এতটুকুই যথেষ্ট যে কোনো দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে ইসলাম চিন্তা ও বিবেককেই প্রধান শর্ত করেছে। তাই ইসলাম কেবল চিন্তাশক্তিসম্পন্ন বিবেকবান লোকদের তার বিধিনিষেধ পালনের নির্দেশ দিয়েছে। যারা চিন্তাশক্তি হারিয়েছে, যারা বোধ-বুদ্ধি হারিয়েছে, যারা পাগল, ইসলামে তারা মুকাল্লাফই নয়।
ইসলামী সমাজ তাই বিবেকের সুষ্ঠু চর্চা ও চিন্তাশীলতার চর্যার একটি সমাজ। কিন্তু আজকের মুসলিম সমাজের সবচে উপেক্ষিত বিষযটির নাম চিন্তাশীলতা। যে সমাজে এমন হয়, সেখানে গতি থাকে না, সৃজন থাকে না, মহত্বের বিকাশ থাকে না। সে সমাজ হয় অবনতিশীল একটি বন্ধ্যা সমাজ। একটি চিন্তারিক্ত বন্ধ্যা সমাজ একটি গুরুস্তান। যেখানে মৃতেরা জীবিতের নামে অভিনয় করে চলে।
পতন ও পচন যার জন্য নিত্যই অপেক্ষমান থাকে। জীবনের লাগাম তার হাতে থেকে ছিটকে পড়ে। সে হারায় প্রাণশক্তি, উদ্যম ও আত্মবোধ। যখন কোনো জাতির সবচে দুর্বল ও অকর্মন্য অঙ্গ হয় মস্তিস্ক, তখন সেই জাতির দুর্দশা রোধ করার চেয়ে কঠিন কাজ জগতে আর হতে পারে না। কেননা এ জাতির সদস্যরা নিজেরাই নিজেদের দুর্দশা নিশ্চিত করতে থাকে। নিজেরাই হতে থাকে নিজেদের জন্য চলমান মুসিবত।
মুসলিমদের চিন্তাদৈন্যের চিত্র কোনো পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝানো যাবে না। বহু শতাব্দী ধরে এটা চলে আসছে। অথচ বিগত শতকগুলোতে সারা দুনিয়ায় চিন্তার উত্থান ও উদ্ভাসের বন্যা বয়ে গেছে। প্রতিটি জাতি অধিক থেকে অধিকতর চিন্তাসম্পদে ধনী হবার প্রতিযোগিতা করেছে। জার্মানরা চিন্তাচর্চায় দুনিয়ার অগ্রসর জাতি। কিন্তু দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার বড় আফসোস করতেন তাদের নিয়ে। বলতেন- ‘এই চিন্তামূলক সময়ে সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হল যে আমরা এখনও চিন্তা করছি না।’
হাইডেগারের ভাষা ধার করে আমার বলতে ইচ্ছে করে- চিন্তাউদ্দীপক মহাগ্রন্থ হাতে পেয়ে, চিন্তাউন্মোচক জীবনদর্শন কাছে পেয়ে, চিন্তা জাগরণের সমৃদ্ধ অতীত থাকা সত্ত্বেও এই চিন্তামূলক সময়ে মুসলিমরা চিন্তা করতে ভুলে গেছে, এটা অনেক বড় চিন্তার বিষয়!