পূর্বপাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের সবচে আলোচিত ও সমালোচিত বিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের অন্যতম হচ্ছেন অধ্যাপক গোলাম আযম। তিনি একইসাথে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের জন্ম দেখেছেন। বাংলাদেশ ও স্বাধীনতাপূর্ব পাকিস্তানের সব ধরনের রাজনৈতিক উত্থান পতনের চাক্ষুষ সাক্ষী তিনি। তাছাড়া নেতৃত্বের বিচক্ষণতার জন্যও তার স্বীকৃত রয়েছে সর্ব মহলে। আর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তো আছেই। সবকিছু মিলিয়ে তার আত্মজীবনী পড়তে বেশ আগ্রহ বোধ করছিলাম।
‘জীবনে যা দেখলাম’ শিরোনামে দৈনিক সংগ্রামের জন্য লেখা ধারাবাহিক কলামের সংকলনই হচ্ছে তার আত্মজীবনী। মোট বারো খণ্ডে ছাপা হয়েছে সম্ভবত। সবগুলোই প্রায় তিনশো পৃষ্ঠার কলেবরে। দুঃখের বিষয় হলো, যার কাছ থেকে সংগ্রহ করলাম, তার কাছে প্রথম খণ্ডটা নেই! কিছুটা হতাশ হলাম। তবে জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্টতার পূর্ণ বিবরণী দ্বিতীয় খণ্ডে থাকায় এ খণ্ডটির প্রতি বেশি আগ্রহ কাজ করছিলো।
১৯৫২ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত এ সময়টা জামাতের উত্থান কাল। গোলাম আযমের আত্মজীবনী যেহেতু, তাই এ সময়টা অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মৌলিক একটা ধারণা পাওয়া যায় এই খণ্ডে। মুসলিম লীগ এর রাজনৈতিক ব্যর্থতা, নির্বাচনে ভরাডুবি, ফাটল সৃষ্টি, নতুন অনেক দলের জন্ম, ইসলামী নেতৃত্ব ও ঐক্যের সঙ্কট, আইয়ুব খানের স্বৈরশাসন ইত্যাদির বিস্তারিত আলোচনা এসেছে।
গোলাম আযম ও মাওলানা মওদুদী সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। যা এখানেই প্রথম জেনেছি, এবং অনেকটা বিস্মিতও হয়েছি। কিছু এখানে উল্লেখ করছি। গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেয়ার আগে রংপুরের তাবলীগ জামাতের আমির ছিলেন। তিনবার তিন চিল্লা ও চারবার এক চিল্লার সাথী। এবং তখনের মুরুব্বি মাওলানা আব্দুল আযীয রহ. এর খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ৫২তে ভাষা আন্দোলনের জন্য গ্রেপ্তার হয়ে এক মাস জেল খাটেন গোলাম আযম। ক্লাস নাইন থেকে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী রহ. এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। এবং তা হযরতের মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল।মাওলানা মওদুদী জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের মুখপাত্র অর্ধ-সপ্তাহিক ‘আল জমিয়ত’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন| এ ছাড়াও আরো বেশ কিছু চমৎকৃত হওয়ার মত তথ্য জানা যায়।
যাহোক, এই খণ্ডে গোলাম আযম তার তাবলীগ ছেড়ে জামায়াতের সাথে জড়িয়ে পড়ার বিস্তারিত বর্ণণা দিয়েছেন। এবং এর যৌক্তিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। এই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কিছু হাস্যকর তথ্যের আবর্তন ঘটিয়েছেন। যেমন জামায়াতে যোগ দেয়ার পিছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে বড় যে কারণটি উল্লেখ করেছেন, তা হলো একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে না পাওয়া! প্রশ্নটি ছিল —‘তাবলীগ যদি ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কাজ করে থাকে, তাহলে সরকার তাদেরকে বাধা দেয় না কেন?’ এই প্রশ্নটি তাকে করেছিল জামায়াতের তখনকার এক আঞ্চলিক নেতা। গোলাম আযমের ভাষায় এ প্রশ্ন তার মাথায় ঢুকার পর থেকে, তার খাওয়া দাওয়া ঘুম বন্ধ হয়ে যায়! কোনভাবেই এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি!
গোলাম আযমের মত বিচক্ষণ ব্যক্তিও নিজেকে যৌক্তিক প্রমাণ করার স্বার্থে এমন কুযুক্তির আশ্রয় নিতে পারেন, ভেবে হোঁচট খেলাম! চিন্তা করছিলাম যখন তিনি এই লেখাটা লিখছিল-(২০০২), তখনকার সরকার তো ইসলামী সরকার ছিল না! তারপরও জামায়াতে ইসলামীর মত একটা ইসলামী দলকে কেন মাথায় তুলে রেখেছিল? সে প্রশ্ন কি তখন তার মাথায় আসেনি? অথচ একজন সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানা থাকার কথা, কোন সংগঠনকে বাধা দেয়া না দেয়া নির্ভর করে ঐ সংগঠনটি সমসাময়িক সরকারের জন্য কতটা হুমকি, তার উপর।
এছাড়া তাবলিগ ছাড়ার পিছনে যে কারণটি বারবার উল্লেখ করেছেন তা হলো, ‘তাবলিগে শুধু ধর্মচর্চার বিষয়টাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। অথচ ইসলাম শুধু ধর্মের নাম না। ইসলাম একটি বিপ্লবের নাম। রসূলের বিপ্লবী জীবনের পুরোটাই প্রত্যেক মুসলমানের জন্য অনুসরণীয় আদর্শ।’
এখানে বক্তব্যের মর্ম কথার সাথে আমি একমত। কিন্তু ‘ইসলাম শুধুই ধর্ম নয়’ এ বাক্যের সাথে একমত না। এ বাক্যের ঠিক কী অর্থ দাঁড়ায়, তা আমার আসলে বুঝে আসেনি! রসূলের বিপ্লবী জীবনের সাথে ধর্মের সংঘাত কোথায়? রসূল যা করেছেন পুরোটাই তো ধর্ম। তাহলে ইসলাম শুধু ধর্ম নয় বলে বিপ্লবী জীবনকে আলাদাভাবে উল্লেখ করার অর্থ কী? ইসলাম শুধুই ধর্ম। তবে এই ধর্ম পূর্ণ জীবন-ব্যবস্থার নাম। জিহাদ, সংগ্রাম, বিপ্লব সবকিছু ধর্মেরই অংশ। তাই ‘ইসলাম শুধু ধর্ম নয়’ বলাটা অনুচিত বলে মনে হয়।
মজার ব্যপার হলো, জামায়াতে যোগ দেয়ার আগে গোলাম আযম ‘তমদ্দুন মজলিস’ নামে একটা সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তখন তাবলীগেও সক্রিয় ছিলেন। এক সাথে উভয় সংগঠনে কাজ করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যে, তমদ্দুন মজলিসে রাজনৈতিক বা বিপ্লবী উদ্যোগে গুরত্ব বেশি ছিল। ধর্মচর্চার বিষয়ে গুরত্ব কম দেয়া হতো। কিন্তু অন্যদিকে তাবলীগে এ বিষয়ে গুরুত্ব বেশি ছিল। তাই আমি দুটো সংগঠনের সাথেই যুক্ত ছিলাম। যাতে ধর্মের কোনদিক ছুটে না যায়।
এখানে যে প্রশ্নটা গুরত্বের সাথে প্রাসঙ্গিক, তা হচ্ছে যখন তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দিয়ে তাবলিগের সাথে পুরোপুরিভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন, তখন ধর্মচর্চার গুরত্বের বিষয়টা তার মাথায় আসেনি কেন? জামাতে নিশ্চয় ধর্মচর্চার বিষয়কে তাবলিগের মত করে গুরত্ব দেয়া হয় না!
যাহোক! গোলাম আযম একজন সফল সংগঠক। নেতৃত্বের অনেক গুণই তার ছিল। একজন দলনেতার যত ধরনের কৌশল জানা দরকার, তার অনেকটাই হয়ত আয়ত্বে ছিল তার। ইতিবাচক মনোভাবই তাকে খুব অল্প সময়ে জনসাধারণে জনপ্রিয় করে তুলে। বক্তব্যে সম্ভ্রান্তের ছাপ অটুট রেখেছেন। যাদের সাথে আদর্শিক দ্বন্দ্ব ছিল, তাদের ব্যাপারেও কোন কটু বাক্যব্যয় করতে দেখা যায়নি। বিশেষত ওলামায়ে দেওবন্দের সাথে তাদের আদর্শিক দ্বন্দ্ব সর্বত্র আলোচিত হলেও, তিনি তা দূরদর্শিতার সাথে এড়িয়ে গেছেন।
বাংলাদেশের শাসনরাজ্য যেহেতু দুই পরিবারের মাঝে ভাগবাটোয়ারা হয়ে আছে, তাই কিছুটা নিরপেক্ষ জায়গা থেকে বিবেচনা পর্যালোচনা করার জন্য গোলাম আযমকে পড়া জরুরি। আর বর্তমান সরকারের ‘রাজনৈতিক মুক্তিযুদ্ধের’ হালচাল বোঝার জন্যও ৯৬ ও তার আগের প্রেক্ষাপট বুঝা প্রয়োজন।