দীর্ঘ তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর সব ধর্ম, সভ্যতা আর সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার পর কোন দার্শনিক যখন ইসলামে দীক্ষিত হন, তখন বুঝতে হবে তিনি বুঝেশুনেই ইসলাম কবুল করেছেন৷ তাঁর প্রতিটি রচনায় পাশ্চাত্যের মিথ্যা খোলস খসে পড়ে বেরিয়ে আসে কদর্য রূপ । ঔজ্জ্বল্য ও অসীম প্রাণশক্তিতে ফুটে ওঠে ইসলাম। মুরাদ হফম্যানের কথা বলছি। বলছি তাঁর ‘ইসলাম ২০০০’ বইটির কথা। পুরো বইটিই হয়ে ওঠেছে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পশ্চিমা ও ইসলামের তুলনামূলক সভ্যতাতত্ত্বের উজ্জ্বল দীপাধার। প্রগাঢ় চিন্তা ও বুদ্ধিজীবিতার ভাষায় তিনি পাশ্চাত্যকে তুলোধোনা করেছেন। সুসংক্ষিপ্ত সুসমৃদ্ধ এই বইটির সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা তুলে ধরছি।
বইয়ের নাম : ইসলাম ২০০০
লেখক : মুরাদ উইলফ্রেড হফম্যান।
অনুবাদ : মোঃ এনামুল হক
প্রকাশক : বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি, চট্টগ্রাম।
লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচয় :
প্রথম জীবনে মুরাদ ছিলেন একজন ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ও দার্শনিক। পরবর্তীতে তিনি বিভিন্ন ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার এক পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তার জন্ম হয়েছিল ১৯৩১ সালের ৬ ই জুলাই, জার্মানীর Aschaffenburg- এর এক ক্যাথলিক পরিবারে। পড়াশোনা করেন New York-এর Schenectady- তে Union Collage-এ। ১৯৫৭ সালে Munich University থেকে আইনের পারদর্শিতার উপর ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর আমেরিকার আইনের উপর পড়াশোনা করতে গিয়ে ১৯৬০ সালে তিনি প্রখ্যাত Harvard Law School থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি দীর্ঘ কয়েক যুগ জার্মানির রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে ‘ইসলাম দি অলটারনেটিভ’ গ্রন্থ রচনার পর তাকে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী আখ্যা দিয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বসবাস করছেন।
বইয়ে যে সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে :
১. মুসলিম ভবিষ্যৎ তত্ত্ব
২. সামান্য আশাবাদ
৩. সৃষ্টিতত্ত্বের পুনর্মূল্যায়ন
৪. ইসলাম কীসের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়
৫. ইসলাম ও পাশ্চাত্য : পুনরায় মুখোমুখি
৬. কীভাবে ধ্বংস এড়িয়ে চলা যায় এবং ইসলামের কাজ করা যায়
৭. আমাদের করণীয় : কী বিশাল দায়িত্ব
বইয়ে আলোচিত সাতটি অধ্যায়ের সার সংক্ষেপ
১.
ইসলামের ভবিষ্যত কী-এ প্রশ্নের জবাবে মুরাদ হফম্যান মুসলিম জাহানে আলোচিত তিনটি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। প্রথমতঃ একদল মুসলিম মনে করে ইসলাম ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে চলেছে। দিন যত যাচ্ছে মুসলিম উম্মাহ ততই অধঃপতনের শিকার হচ্ছে। আরেক দল মুসলিম মনে করে, ইসলাম ক্রমবিকাশমান। সাময়িক বিচ্যুতি ঘটলেও তা কাটিয়ে ইসলাম আবার উঠে দাঁড়ায়, ঘুরে দাঁড়ায়। তৃতীয় আরেকদল মুসলিমের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ইসলাম নদীর জোয়ার ভাটার মতই কখনো অস্তিত্বের জানান দিয়েছে, কখনো শিকার হয়েছে পতনের। ত্রিমুখী মানসিকতার মধ্যে মুরাদ আশাবাদের দিকটাই ফুটিয়ে তুলেছেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে।
২.
ভিন্ন আরেকটি অধ্যায়ে পশ্চিমা জগতের আধ্যাত্মিক সঙ্কট ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রচলিত খ্রিষ্টবাদের মাধ্যমে। মুরাদ হফম্যানের মতে , যিশুকে ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে বিশ্বাস করাটাই আধুনিক ইউরোপের সবচেয়ে বড় বুদ্ধিবৃত্তিক পতন। যেখানে তারা চরমভাবে হোঁচট খেয়েও গোঁড়ামি বশত মিথ্যাকে আড়াল করে রাখছে।
৩.
মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়ালেও পশ্চিমা জগৎ কী পরিমাণ কট্টর খ্রিষ্টবাদের ধারক, তা জানা যায় তাদের ব্যাপটিজম, চার্চে বিয়ে এবং চার্চের সহায়তায় সমাহিতকরণ ইত্যাদি আচরণের মাধ্যমে। জাতীয়ভাবে পালন করা হয় বড়দিন। প্রতি শনিবার ও রবিবার বন্ধ থাকে অফিস আদালত খ্রিষ্টীয় বিশেষ দিন হিসাবে। এর বাইরে অন্য সব ধর্মের প্রতি থাকে প্রবল বিতৃষ্ণা আর বিদ্বেষী মনোভাব। আর পশ্চিমা এসব কালচারকে মুসলিম দেশগুলো এমনভাবে লুফে নিয়েছে যেন তারা পাশ্চাত্যের সাথে ধর্মহীনতার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। একজন অমুসিলম পর্যটক যখন তথাকথিত মুসলিম দেশসমূহে মদ ও শূকরের মাংস, অশ্লীলতা ও অবাধ যৌনতা, ১৪% সুদে সরকারি ঋণব্যবস্থা আর পশ্চিমাদের দিনপঞ্জি অনুসারে খ্রিষ্টানদের মত শনিবার অর্ধেক ও রবিবার পূর্ণ সাপ্তাহিক ছুটির দিন মেনে চলা হচ্ছে দেখে , তখন সে বুঝতে পারে না এটা কি ইস্তাম্বুল নাকি লাস ভেগাস!
৪.
১৯৯০ সালে ইউরোপের একমাত্র মুসলিম অঞ্চল বসনিয়াতে যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, গ্রীক ও সার্বিয়ার গণমাধ্যম সেই গণহত্যাকে ক্রসেড আখ্যায়িত করে স্বাগত জানিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমস তাকে আখ্যা দিয়েছে ময়লা সাফ করা বলে। এভাবে খোলস পাল্টালেও আধুনিক ইউরোপ মধ্যযুগের মতই ক্রসেডের চেতনায় মারমুখী অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে ব্যবধান শুধু এইটুকু যে, আগে পোপ ক্রসেডের ডাক দিতো আর এখন সেই ডাক আসবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে। আসলে ইউরোপের মাটিতে একটা মুসলিম রাষ্ট্র সহ্য করার চেয়ে একটা গোটা মুসলিম জনগোষ্ঠী ধ্বংস করতেও তারা প্রস্তুত।
৫.
মনে করা হয়, ইসলাম আধুনিক বিশ্বের সাথে সংঘাতে লিপ্ত। অথচ বাস্তবতা হলো, ইসলাম চিরআধুনিক। কেয়ামত পর্যন্ত আগত সময়ের জন্য সর্বজনীন। এজন্য মুসলিম জাহানে কিছু ক্ষেত্রে আরো সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। যেমন:
– শিক্ষা ও প্রযুক্তি
– নারীমুক্তি ও নারীর প্রতি ইসলামের অধিকারগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়ন
– মানবাধিকার
– রাষ্ট্র ও সুষম মানসম্পন্ন অর্থনীতি
– যোগাযোগ
এর সাথে সাথে কিছু বিষয়ের মধ্যকার পার্থক্য স্পষ্ট করতে হবে। যেমন:
– ধর্ম হিসেবে ইসলাম ও সভ্যতা হিসেবে ইসলাম- এ দুয়ের মধ্যকার পার্থক্য
– শরিয়াহ এবং ফিকহের মধ্যকার পার্থক্য
– সহীহ ও সন্দেহযুক্ত হাদীসের মধ্যকার পার্থক্য
– কোরআন ও সুন্নাহর মধ্যকার পার্থক্য।
বইটি ইসলামের এত সুন্দর ও সূক্ষ্ম চিন্তা ও বুদ্ধিজীবিতার খোরাক জোগায় যে, বইটি সবারই পড়া দরকার। এ পর্যন্ত আমি চারবার পড়েছি। তথাকথিত মুসলিম দেশগুলোর বিপরীতে সম্পূর্ণরূপে ইসলামের আদর্শে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন তিনি।
বইয়ে উদ্ধৃত কিছু গ্রন্থাবলী :
১. মরিস বুকাইলি : দ্য বাইবেল, দ্য কুরআন অ্যান্ড সায়েন্স
২. মুহাম্মদ আসাদ : দ্য মেসেজ অব কুরআন
৩. মরিয়ম জামিলা : মুসলিম ওয়ার্ল্ড বুক রিভিউ
৪. আকবর এস আহমেদ : বসনিয়া দ্য লাস্ট ক্রসেড
৫. আবুল আলা মওদুদী : হিউম্যান রাইটস ইন ইসলাম
৬. উইলফ্রেড কেন্টওয়েল স্মিথ :
ইন হোয়াট ইজ স্ক্রীপচার
৭. জস্টিন গার্ডনার : সোফিস ওয়ার্ল্ড
৮. স্টিফেন হকিং : আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব দ্য টাইম : ফ্রম দ্য বিগ ব্যাং টু ব্ল্যাক হোল
৯. রিচার্ড সিনবার্ন : দি এক্সজিসটেন্স অব গড
১০. মুহাম্মদ আসাদ : স্টেট অ্যান্ড গভর্নমেন্ট ইন ইসলাম