নয়া তুরস্কে ধর্ম–অধর্মের যুদ্ধ ও দুটি সাম্প্রতিক ঘটনা
এই তো গেলো রমজানের ঘটনা। তুরস্কের ইজমির প্রদেশের বেশ কিছু মসজিদ থেকে আজানের পরিবর্তে শোনা গেলো গানের শব্দ। হ্যা, সত্যি সত্যি গান বেজে উঠল মসজিদের মাইক থেকে। বিশ্বব্যাপী বামপন্থীদের অ্যান্থম হিসেবে পরিচিত ইতালির ‘বেলা চিও’ নামের একটি গান। মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এ দৃশ্য রেকর্ড করে ছড়িয়ে দেওয়া হলো অনলাইনে এবং সারা দেশে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, চরম ঘৃণ্য এ কাণ্ডের পেছনে যার হাত আছে সে তুরস্কের প্রধান বিরোধী সেক্যুলার দল জেহেপের একজন নারী প্রসিকিউটর। তার সাজেশেই একযোগে ইজমির প্রদেশের প্রায় দশ বারোটি মসজিদ থেকে মাইকে এসে গান ছেড়ে দেয় উগ্র বামপন্থী কিছু যুবক। এটা করে তারা তুরস্কের ইসলামপ্রিয় সমাজকে ও ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে একটা বার্তা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া ছিল কঠিন। তুরস্কের ধর্মপ্রাণ জনগণ এই ঘটনার যে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, তাতেই এর তীব্রতা ফুটে ওঠে। তারা এর জবাবে সবাই যার যার ঘর থেকে জানালার সামনে এসে কিংবা ছাদে ওঠে একযোগে আজান দিয়েছেন। হাজারো কণ্ঠে একসাথে বেজে ওঠেছে আজানের সুর! তুরস্কের বামপন্থী সেক্যুলারদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ‘ইজমির’ প্রদেশ যেন আজানময় হয়ে উঠেছিল সেদিন।
এর আগে রমজানের শুরুতে তুরস্কের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ও প্রধান মুফতী আলী এরবাশের একটি বক্তব্য নিয়ে তুমুল হৈচৈ কাণ্ড বাধায় সেক্যুলারদের একটি মহল। প্রফেসর আলী এরবাশ রমজানের প্রথম জুমায় ইসলামে ব্যভিচার ও হোমোসেক্স হারাম— এ মর্মে বক্তব্য দিলে চটে যায় কট্টর ধর্মবিদ্বেষী ওই শ্রেণিটি। তারা এই বক্তব্যকে চরম অপমানকর আখ্যা দিয়ে আলী এরবাশের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। দাবী তোলে— ভুল স্বীকার করে পদত্যাগ করতে হবে। তাদের সমর্থন দিতে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মদদপুষ্ট বিভিন্ন সংগঠন, বামপন্থী রাজনীতিক ও উকিলরা। আস্কারা পেয়ে এক পর্যায়ে এই শ্রেণিটি যিনা–ব্যভিচার হারাম হওয়া সংশ্লিষ্ট কুরআনের আয়াত মুছে ফেলার দাবিও তোলে প্রকাশ্যে। এমন পরিস্থিতিতে এরদোয়ান বক্তব্য দেন যে, প্রফেসর আলী এরবাশ যা বলেছেন সেটাই ইসলামের বক্তব্য। সুতরাং আলী এরবাশের বিরোধিতার মানে হবে ইসলামের বিরোধিতা। আর ইসলামের বিরোধিতার মানে হবে রাষ্ট্রের বিরোধিতা। সুতরাং সবাই যেন সীমা বজায় রেখে চলে।
পরিবর্তনের হাতিয়ার : শিক্ষা ও সংস্কৃতি
সেক্যুলারিজম ও ধর্মহীনতার সাথে টেক্কা দিয়ে দীর্ঘ সতেরো বছরের শাসনে এরদোয়ানের আকপার্টি পাবলিক প্লেসে ইসলামকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এবং সেই চেষ্টার কল্যাণে শুধু তুরস্কের ভিতরেই নয়, পুরো মুসলিম বিশ্বে একটা বিশেষ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে এরদোয়ানের। এক্ষেত্রে সামাজিকভাবে পরিবর্তনের এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে মোক্ষম যে হাতিয়ারগুলো এরদোয়ান কৌশলে ব্যবহার করেছেন সেগুলো হলো শিক্ষা ও সংস্কৃতি।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, শিক্ষাই একটি জাতির ভবিষ্যত রোডম্যাপ। জাতির প্রজন্ম যে শিক্ষায় গড়ে ওঠে, সেই শিক্ষাকেই ধারণ করে পরিবার, সমাজ, প্রশাসন, রাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রব্যবস্থা। এরদোয়ান বুদ্ধিমত্তার সাথে এ খাতটিকে কাজে লাগিয়েছেন। বিগত সতেরো বছরের শাসনে ধর্মীয় শিক্ষা বিস্তারে ব্যাপক কাজ করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমসের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, যেখানে তুরস্কে ২০০২ সালে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৪৫০, সেখানে ২০১৮ সালে এসে সে সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৫০০ তে। অন্যদিকে রয়টার্সের একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১২ সালে ৪ হাজার ইমাম হাতিপ স্কুলের যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ছিল, ২০১৮ সালে সে সংখ্যা পাঁচ গুণ বেড়েছে। ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী। এসবের বাইরে সাধারণ বিদ্যালয়গুলোতেও জোরদার করা হয়েছে ধর্মীয় শিক্ষা। এই তো কিছুদিন আগেও তুরস্কে একধরনের এলিট স্কুলের প্রচলন ছিল। যেগুলো নিয়ন্ত্রণ করত আর্মি ও বিমানবাহিনী। ওখানে শুধু সামরিক বাহিনীর সন্তনরাই পড়তে পারত। আতাতুর্কের নীতি অনুসারে তাদেরকে এন্টি ইসলামিক ভাবধারায় গড়ে তোলা হত। এবং একসময় তারাই ভর্তি হত মিলিটারিতে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এসব স্কুলও এখন বন্ধ করা হয়েছে। ২০১৬ এর সেনা অভ্যুত্থানের কারণে এসব এলিট স্কুল আর নেই এখন।
ধার্মিক প্রজন্মের উত্থান
এসবের ফল হয়েছে এই যে, তুরস্কে মোটামুটি ধার্মিক প্রজন্ম গড়ে ওঠেছে। এখন যারা সেনাবাহিনী, প্রশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছে, তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ এই প্রজন্মের। এবং সন্দেহ নেই এই প্রজন্মের হাতেই পুরো তুরস্কের নেতৃত্ব চলে আসবে আগামি দশকগুলোতে। উগ্র সেক্যুলার কামাল আতাতুর্ক তার আঠারো বছরের শাসনে (১৯২২-১৯৩৮) তুরস্ককে যেমন একটি আপাদমস্তক সেক্যুলার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চেয়েছে, এরদোয়ান তার সতেরো বছরের শাসনে ঠিক তার উল্টো ইসলামঘনিষ্ঠ তুরস্ক গঠনের চেষ্টায় নিয়োজিত থেকেছে। এর ফলে সেনাবাহিনী থেকে সরকারি অফিসার, ডাক্তার থেকে ইঞ্জিনিয়ার, এবং কৃষক থেকে ব্যবসায়ী সর্বস্তরে মোটামুটি ধর্মীয় আবহে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম গড়ে উঠেছে। আর এসবের মূলে কাজ করেছে এরদোয়ানের ‘ধর্মভীরু প্রজন্ম’ গড়ার পরিকল্পনা।
ধর্মের সামাজিক প্রয়োগ
কিছুদিন আগে এরদোয়ান তার শৈশবের ইমাম হাতিপ স্কুল পরিদর্শনে যান। যে প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মীয় পড়াশোনার হাতেখড়ি নিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি নিজে বাচ্চাদেরকে কুরআন শরীফ পড়ান। তাদেরকে পড়াশোনায় উৎসাহিত করেন। খোঁজ খবর নেন। সেখানে এক কনফারেন্সে তিনি বলেন, ‘ইমাম হাতিপ সহ আমাদের সকল শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ হল, এই প্রজন্মকে জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে সাথে আপন ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের ওপর গড়ে তোলা।’
তবে এসব প্রতিষ্ঠানেই সীমিত না থেকে বাস্তব জীবনে বাচ্চাদেরকে ধর্মীয় আবহে গড়ে তোলার উদ্যোগও গ্রহণ করেছে তুরস্কের সরকার। লাগাতার চল্লিশ দিন ফজরের নামাজ জামাতে পড়তে পারলে সাইকেল উপহার দিচ্ছেন স্বয়ং প্রেসিডেন্ট। মসজিদের পাশেই বিশেষ ব্যবস্থাপনায় তৈরি করা হচ্ছে খেলার মাঠ। যেন খেলার মত মসজিদও প্রিয় হয়ে যায় বাচ্চাদের কাছে। এসব ছাড়াও পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই নতুন করে ঢেলে সাজানো হচ্ছে । শিক্ষাব্যবস্থার কোন ফাঁক ফোকরে যেন নাস্তিকতার বীজ না থাকে, নেওয়া হচ্ছে সেই ব্যবস্থাও। ২০১৭ সালে তুরস্কের শিক্ষা কারিকুলাম থেকে ডারউইনের বিবর্তন মতবাদ বিলুপ্ত করা হয়েছে।
শুধুই কি ধর্মশিক্ষা?
উপরের আলোচনা থেকে যদি একথা মনে হয় যে, তিনি শুধু ধর্মীয় শিক্ষাকেই প্রধান্য দিচ্ছেন, তাহলে ভুল হবে। বরং তিনি শিক্ষাব্যবস্থার ধর্মের প্রতি শত্রুতা লালনকারী দৃষ্টিভঙ্গিকে ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীলতার দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এই যা, এরচেয়ে বেশি কিছু নয়। তা না হলে, শিল্প ও প্রযুক্তিতে এমন শক্তিশালী তুরস্ককে দেখতো না আজকের বিশ্ব। আজকের তুরস্ককে বিশ্ব দেখছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার এক অনন্য মডেল রূপে। যে দেশ তার একজন মাত্র নাগরিককে করোনা থেকে উদ্ধার করতে পুরো একটি অ্যাম্বুলেন্স বিমান পাঠায় সুইডেনে, বাংলাদেশ ও মিশরে। আঙ্কারার বিমানবন্দরে যখন আমেরিকা ও বৃটেনের চিকিৎসা সাহায্যপ্রার্থী কার্গোবিমান অপেক্ষা করছে, তখন তুরস্কের জনগণ হ্যাশট্যাগ দিয়ে «Biz bize yeteriz Türkiyem» তথা ‘আমরাই আমাদের জন্য যথেষ্ট’ বলে সামাজিক প্রচার অভিযান শুরু করেছে। সাহায্য না পেয়ে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট যখন ‘ইউরোপীয় ঐক্যে’র ধারণাকে ‘রূপকথা’ বলে শোরগোল তুলেছেন, তখন তুরস্কের কাছে চিকিৎসা সহায়তা চেয়ে আবেদন জানিয়েছে পৃথিবীর ১০০ টিরও বেশি দেশ। রোম আর মাদ্রিদ যখন করোনার আগুনে পুড়ছে তখন, ইউরোপের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল নির্মিত হচ্ছে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে।
এ তো গেলো স্বাস্থ্যখাত। নতুন তুরস্ক প্রযুক্তিতেও টেক্কা দিয়ে চলছে ইউরোপ ও রাশিয়াকে। সিরিয়ার ইদলিবকে স্বৈরাচারী আসাদ বাহিনির হামলা থেকে রক্ষার্থে তুর্কি ড্রোন যখন তার শৌর্য দেখাচ্ছে, তখন মস্কো থেকে এসেছে যুদ্ধবিরতি দিয়ে আলোচনায় বসার আহবান। লিবিয়ার যুদ্ধবাজ জেনারেল হাফতারের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকিয়েছে ‘বায়রাকদার’ নামের ড্রোন, তখন পঞ্চম প্রজন্মের ‘আকিঞ্জি’ নামের নতুন বিশেষ ড্রোনের ডকুমেন্টস উন্মোচন হয়েছে আনকারায়। তেলসম্পদে ভরপুর একনায়ক আরবদেশগুলো যখন প্রযুক্তির জন্য বেইজিংয়ের কাছে ধর্না দিচ্ছে, তখন শতভাগ তুরস্কের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি অত্যাধুনিক বিদ্যুৎচালিত কার ‘টগে’র কয়েক হাজার অর্ডার এসেছে ইউরোপ থেকে। এ সবই প্রমাণ করে শুধু ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, আধুনিক ও প্রযুক্তিগত বহুমুখি শিক্ষায়ও এরদোয়ান কী পরিমাণ সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন।
তুরস্কের ইসলামোফোব প্রেক্ষাপট নিয়ে যে বাতচিত করা হলো, এইসব কাহিনি আজ বাংলাদেশেও চলমান নিকাব ইস্যুতে। এর বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে, অনলাইনেও জানানো হচ্ছে প্রতিবাদ। এই ধারা অব্যাহত থাকুক। কিন্তু, বাস্তবতা হলো, এসব ব্যবস্থা একদমই ভাসা ভাসা পর্যায়ের। ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর ও স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে সমস্যার গোড়ায় হাত না দিলে এসব চলতেই থাকবে। হয় সরাসরি রাষ্ট্রের ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে নাহয়, রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীনদের আনতে হবে পরিপূর্ণ ইসলামের ছায়ায়। এই বাস্তবতা মেনে নিয়ে যত দ্রুত ময়দানে নামা যাবে, ততই কল্যাণ হবে ইসলাম, উম্মাহ ও সভ্যতার। যুগ যুগ আগে যে কল্যাণ সাধনের পথ দেখিয়ে গেছেন নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রস্তাবক মহান মুজাহিদ নাজমুদ্দীন এরবাকান আর আলী ইযযেত বেগোভিচেরা।