ফিলিস্তিনিরা এক সংগ্রামী জাতি বটে। তারা প্রায় এক শতক ধরে নিজেদের ভূখণ্ডে দখলদার ইহুদিদের হাতে মার খাচ্ছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ঝরছে রক্ত। লাশের পাহাড় আকাশ ছুঁয়েছে। ফিলিস্তিনিরা কেবল মরছেই।
ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। আরব মুসলমানেরা ছিল সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। উনিশ শতকের শেষ দিকে জায়নবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ইহুদিদের চোখ পড়ে আরব ভূখণ্ডে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসে বাসা বাঁধতে থাকে। তাদের সংখ্যা ক্রমে বাড়ে। সবকিছুর উদ্দেশ্য—আরব ভূখণ্ড দখল করে ‘আবাসভূমি’ গড়ে তোলা।
বিশ শতকের শুরুর দিকে অটোমান সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ইউরোপীয় শক্তিগুলো তাদের প্রভাব বাড়ায়। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহে নামায় ব্রিটিশ সরকার। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইহুদিদেরও গোপনে আশ্বাস দেওয়া হয়।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার বেলফোর ঘোষণা, ফিলিস্তিনে ‘ইহুদিদের একটি জাতীয় বাসস্থান’ প্রতিষ্ঠায় সমর্থন, অটোমান সাম্রাজ্যের পতন, সহ ফিলিস্তিনের গোড়া থেকে ফিলিস্তিনের হাজার বছরের ইতিহাস তুলে আনা হচ্ছপ এই লেখায়।
ফিলিস্তিনের ভৌগলিক অবস্থান ও আয়তন :
এশিয়া মহাদেশের সর্ব পশ্চিমে ও ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে অবস্থিত ফিলিস্তিন। পূর্বে সিরিয়া ও জর্ডান,
উত্তরে লেবানন, দক্ষিণে আকাবা উপসাগর এবং দক্ষিণ পশ্চিমে মিশরের সিনাই উপত্যকা দ্বারা বেষ্টিত এই জনপদ।
ফিলিস্তিনের মোট আয়তন ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার।
প্রাচীনকালে ফিলিস্তিন :
প্রাচীনকালে ফিলিস্তিন ‘কিনান দেশ’ নামে পরিচিত ছিলো। কিনানিরা খৃস্টপূর্ব তিন হাজার অব্দে আরব উপদ্বীপ থেকে ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করে। এভাবে অঞ্চলটিকে কেন্দ্র করে একটি শক্তিশালী নগর সভ্যতা গড়ে উঠে। তাদের নির্মিত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো আল-কুদস শহর।
খৃস্টপূর্ব দু হাজার অব্দে হযরত ইব্রাহিমের (আ.) ফিলিস্তিনে হিজরত করেন। তারপর এই পবিত্র ভূমি অনেক নবী-রাসুলগণের আগমনে ধন্য হয়। ফিলিস্তিনে জন্ম লাভ করা নবী-রাসুলগণের অন্যতম হলেন, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ ও ঈসা (আ.)। দাউদ (আ.)ও তাঁর পুত্র হযরত সুলাইমান (আ.) ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেন। কিন্তু সুলাইমানের (আ.) উত্তরসূরীদের মধ্যে ক্ষমতাদ্বন্দ্বে সেই বরকতময় সাম্রাজ্যটি ভেঙে দু’ভাগ হয়ে যায়। এই দু’টি রাজ্য উত্তরে ‘ইসরায়েল রাজ্য’ ও দক্ষিণে ‘ইয়াহুদা রাজ্য’ নামে আলাদা আলাদা শাসক দ্বারা শাসিত হতে থাকে বহুকাল।
খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অ্যাসিরিয়ান ও ব্যাবলিয়ানদের আক্রমণের মুখে পবিত্র নগরী জেরুজালেমের পতন ঘটলে ফিলিস্তিন পূনরায় কিনানীদের দখলে চলে যায়।
খৃস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শুরুভাগে গ্রীক সম্রাট আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট পারস্য সাম্রাজ্য দখল করে নিলে ফিলিস্তিন গ্রীকদের অধিকারে চলে যায়। গ্রীক রাজ-বংশের পতন হলে ফিলিস্তিন চলে যায় রোমানদের দখলে। দুষ্ট ইহুদিরা রোমান শাসনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বসলে রোমান সম্রাট ৭০ খৃস্টাব্দ ও ১৩৫ খৃস্টাব্দে পরপর দুটো গণহত্যা চালিয়ে ইহুদি বিদ্রোহকে সমূলে দমন করে।
সর্বশেষ ফিলিস্তিনে ঈসার (আ.) আগমন করে খৃস্টধর্ম প্রচার করেন। তাঁর ঊর্ধ্বলোক গমনের দীর্ঘদিন পর খৃস্টধর্ম রোমান সাম্রাজ্যে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে; ফলে ফিলিস্তিনে অবস্থিত বায়তুল মাকদিস শহর রোমানদের কাছে পবিত্র শহরের মর্যাদা পায়। ইসলাম বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত বায়তুল মাকদিস রোমান খৃস্টানদের শাসনাধীন থাকে।
ফিলিস্তিনে ইসলামি বিজয় :
দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের রাযি. এর খেলাফতকাল ১৬ হি. / ৬৩৭ সালে বিখ্যাত সেনানায়ক আমর ইবনুল আস রাযি. ফিলিস্তিন জয় করেন। জেরুজালেম শহরে ইহুদি বসতি স্থাপনের অনুমতি না দেওয়ার শর্তে শহরের গভর্নর পাদার সোফ্রোনিয়াস স্বয়ং মুসলিম বিশ্বের খলিফা ওমর রাযি. এর হাতে পবিত্র নগরীর চাবি হস্তান্তর করেন।
তখন থেকে বায়তুল মাকদিস ইসলামি খেলাফতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। আর কিছুদিনের মধ্যে ইসলামের মহানুভবতা ও অনুপম আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে ফিলিস্তিনিরা ইসলামের সুশীতল ছায়ায় প্রবেশ করেন।
১০৯৯ সালে খৃস্টান ক্রুসেডাররা প্রাচ্যের মুসলিম রাজ বংশগুলোর অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে পবিত্র নগরী জেরুজালেমকে দখল করে নেয়। দীর্ঘ ৮৮ বছর পর সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবি রাহি. ১১৮৭ সালের ঐতিহাসিক হিত্তিন যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে বায়তুল মাকদিস পুনরুদ্ধার করেন। এবং বায়তুল মাকদিসকে পূনরায় ইসলামি শাসনে অন্তর্ভুক্ত করেন। আইয়ুবি রাজবংশের পতনের পর ফিলিস্তিন চলে যায় মিশরীয় মামলুক সালতানাতের অধীনে। সর্বশেষ ১৫১৭ সালে উসমানি শাসক সুলতান সেলিম মামলুক সুলতান তুমান বেয়’কে হটিয়ে মিশর অধিকার করে নেন; এতেকরে ফিলিস্তিনের দায়িত্বভার উসমানীয় খেলাফতের কাঁধে এসে পড়ে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ( ১৯১৪-১৯১৮) উসমানি খেলাফতের পতন ঘটলে ফিলিস্তিন বৃটিশ সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায়। ১৯১৬ সালের সাইকস-পিকট চুক্তি অনুযায়ী উসমানীয় লেভান্তের ফিলিস্তিন এলাকায় বৃটিশদের মেন্ডেট শাসনের সূচনা হয়। মেন্ডেট শাসনাধীন ফিলিস্তিনে লাগামহীন ইহুদি পূনর্বাসনের ফলে ১৯৪৮ সালে ইহুদিরা ফিলিস্তিন দখল করে নেয়।
জায়নিস্ট আন্দোলনের সূচনা : ১৮৯৭ সাল
ফিলিস্তিনে ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কর্মসূচি হাতে নিয়ে ১৮৯৭ সালে সুইজারল্যান্ডের ব্রাসেলস শহরে প্রথম জায়নিস্ট সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে সাংবাদিক থিওডর হারজেলের নেতৃত্বে “আন্তর্জাতিক জায়নিস্ট আন্দোলন” প্রথমবারের মতো বিশ্ববাসীর নজরে আসে।
ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জায়নবাদি প্রচেষ্টা :
ফিলিস্তিনে ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জায়নবাদি নেতারা তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি উসমানি খেলাফত, জার্মান সাম্রাজ্য ও বৃটিশ রাজত্বের দারস্থ হয়।
ইউরোপের সবচেয়ে বেশি ইহুদির বসবাস ছিলো জার্মানিতে। ১৮৯৮ সালে জার্মান সম্রাট বায়তুল মাকদিস পরিদর্শনকালে ইহুদিনেতা থিওডর হারজেল সম্রাটের সাথে সাক্ষাৎ করে। সে জার্মান সম্রাটের কাছে জায়নবাদি পরিকল্পনার রূপরেখা তুলে ধরে সম্রাটকে এই আন্দোলনের পৃষ্ঠপোষকতা করার প্রস্তাব করে। হারজেল সম্রাটের কাছে এটাও নিবেদন করে যে, স্বয়ং সম্রাট যেনো জার্মানির সাথে খেলাফতের সুসম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি নির্মাণের জন্য উসমানীয় খলিফার কাছে সুপারিশ করেন। জার্মান সম্রাট তা বাস্তবায়নে খলিফার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবেন না বলে থিওডর হারজেলকে সাফ জানিয়ে দেন।
সম্রাট থেকে স্বার্থ উদ্ধারে ব্যার্থ হয়ে থিওডর হারজেল সরাসরি উসমানি খিলাফতের শরণাপন্ন হয়।
বহু তদবীরের পর ১৯০২ সালে থিওডর হারজেল উসমানি খলিফা আব্দুল হামিদের সাথে সাক্ষাৎ লাভের অনুমতি পায়।
সেই সাক্ষাৎে থিওডর খলিফার কাছে ফিলিস্তিনে ইহুদি উদ্বাস্তুদের বসতি নির্মাণের অনুমতি প্রার্থনা করে। বিনিময়ে খেলাফতের সমস্ত বিদেশি ঋণ পরিশোধসহ ভঙ্গুর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে মোটা অঙকের আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব করে।
বিদেশি ঋণে জর্জরিত খলিফা এতোবড় লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েও তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করে দেন। খলিফাকে নিজের প্রস্তাবে রাজি করাতে খেলাফতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও দেওয়া হয় মোটা অংকের ঘুষ। খলিফা ইহুদি সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র আঁচ করতে পেরে এই বলে প্রত্যাখ্যান করে দেন, ” উসমানি সালতানাত আমার একার সম্পত্তি নয়, এটা সমগ্র মুসলিম জাতির সম্পত্তি। আমাদের শরীর থেকে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার বিনিময়ে হলেও আমরা খেলাফতের কোনো অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন হতে দিতে পারবো না ” খলিফার কাছ থেকে এমন হতাশাজনক উত্তর শুনে থিওডর সবশেষ ধরনা দেয় বৃটিশ রাজদরবারে।
***
জার্মান ও উসমানি সাম্রাজ্যের কাছে ব্যর্থ হওয়ার পর জায়নবাদিরা নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিরাপদ স্থান হিসেবে বৃটেনকে বেছে নেয়। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে জায়নবাদি পরিকল্পনা ইউরোপীয় স্বার্থের অনুকূলে ছিলো। নির্দিষ্টকরে বললে তা ছিলো বৃটিশ স্বার্থের খুবই অনুকূলে।
এশিয়া ও আফ্রিকার সাথে মুসলিমবিশ্বের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ রক্ষার জন্য ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ছিলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভৌগোলিকভাবে এশিয়া ও আফ্রিকার সংযোগস্থলে ফিলিস্তিন অবস্থিত।
তাই বৃটিশ সরকারকে আফ্রিকায় দখলদারিত্ব বজায় রাখতে হলে ফিলিস্তিনে স্বাধীন ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এশিয়া থেকে আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোকে সহজে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ইউরোপকে ইহুদি মুক্তকরণ,আন্তর্জাতিক ইহুদি সম্প্রদায়ের সমর্থন নিজেদের পক্ষে আদায় করা এবং সুয়েজ খালে অবস্থিত বৃটিশ নৌবহরের সুরক্ষা নিশ্চিত করণসহ আরব অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী আন্দোলনগুলোকে সহজভাবে দমন করার লক্ষ্যে বৃটিশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিন অঞ্চলে একটি বাফারস্টেট গঠনের চিন্তা করে আসছিলো। আর এদিকে জায়নবাদি কর্তৃক ফিলিস্তিনে ইহুদিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিলাষ বৃটিশ সরকারের বাফারস্টেট গঠনের খাহেশ আরও বাড়িয়ে দিলো। তাই বৃটিশ সরকার ইহুদিস্বপ্ন বাস্তবায়নে সর্বাত্মক এগিয়ে আসে।
বেলফোর ঘোষণা : ১৯১৭ সাল
বৃটিশ সরকার নিজেদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে ফিলিস্তিনে স্বাধীন সার্বভৌম ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সর্বাত্মক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২ নভেম্বর ১৯১৭ সালে বিতর্কিত বেলফোর চুক্তি ঘোষণা করে।
ইতিহাসে এই চুক্তি ‘ অ-মালিক কর্তৃক অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে ফিলিস্তিনের ভূমি বরাদ্দ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ” হিসেবে পরিচিত।
বেলফোর ঘোষণার ফলাফল :
বেলফোর ঘোষণার পর ইউরোপ থেকে ফিলিস্তিন অভিমুখে ইহুদি উদ্বাস্তুরা আসতে শুরু করে। বিশেষ করে বৃটিশ মেন্ডেটের পক্ষ থেকে বেলফোর ঘোষণা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইহুদি অভিবাসন নীতি সহজ করা হলে সমগ্র ইউরোপ হতে ইহুদি উদ্বাস্তুদের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার ফিলিস্তিনে উপচে পড়তে থাকে।
বৃটিশদের লাগামহীন অভিবাসন নীতির ফলে দ্রুত স্থানীয় আরব জনগণকে ছাড়িয়ে যায় ইহুদি জনসংখ্যা। অচিরেই সংখ্যালঘু ইহুদিরা হয়ে যায় সংখ্যাগুরু। আর সংখ্যাগুরু আরবরা হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু।
ফিলিস্তিনে বৃটিশ মেন্ডেট শাসন :
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খেলাফতের পতন পরবর্তী উসমানীয় লেভান্ট অঞ্চলকে ফ্রান্স ও বৃটেন নিজেদের মাঝে ভাগবাটোয়ারা করে নেয়। এবং বৃটিশরা ১৯২০ সালের ২৫ এপ্রিলে জায়নবাদের অনুকূলে ফিলিস্তিন এলাকায় মেন্ডেন শাসনের ঘোষণা দেয়।
বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিনে ইহুদিকরণ প্রচেষ্টার তত্ত্বাবধানের জন্য উগ্র জায়নবাদি নেতা হার্বার্ট স্যমুয়েলকে ( ‘ফিউচার অব ফিলিস্তিন’ নামক গোপন পরিকল্পনার মূল হোতা ) প্রথম ভাইসরয় হিসেবে নিয়োগ দেয়।
ফিলিস্তিনকে ইহুদিকরণ করতে হার্বার্ট স্যমুয়েল ভাইসরয় থাকাকালীন বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে । তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে_
১. ফিলিস্তিনে ইহুদি অভিবাসন নীতি সহজকরণ।
২. জায়নবাদিদের ফিলিস্তিনের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সেক্টরে পূনর্বাসনকরণ।
৩. ফিলিস্তিনের ভূমি আরবদের মালিকানা থেকে ইহুদি মালিকানায় হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সহজকরণ ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ইহুদি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকরণ ইত্যাদি।
জায়নবাদিরা স্যমুয়েলের ইহুদিকরণ নীতির সুফল পায় মাত্র ২৫ বছরের মাথায়। স্যমুয়েলের গৃহীত নীতির ফলে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা ৭৫ হাজার থেকে বেড়ে ৭ লক্ষ ৫০ হাজারে উন্নীত হয়। যা পূর্বের তুলনায় মেন্ডেট শাসনের মাত্র ২৫ বছরে ইহুদিদের জনসংখ্যা দশগুণ বেড়ে যায়।
যুগে যুগে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন:
পৃথিবীতে যখনই কোনো জাতি বহিরাগত দখলদারিত্বের শিকার হয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা হারিয়েছে। দেশমাতৃকার স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারে সে জাতির সূর্য সন্তানেরা নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে সংগ্রাম করেছে। এক্ষেত্রে ফিলিস্তিনরাও ভিন্ন ছিলো না; তারাও ঝাঁপিয়ে পড়েছে নিজেদের অধিকার রক্ষায়। ফিলিস্তিনির বেলফোর ঘোষণা ও ফিলিস্তিনে ইহুদিকরণ নীতির বিরোধিতা করে পবিত্রভূমি রক্ষায় আন্দোলন-সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। ফিলিস্তিনদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে জেল, জুলুম, হত্যা, নির্যাতনসহ সবধরনের অপচেষ্টা চালায় ঔপনিবেশিক বৃটিশ প্রশাসন। সে সময় ফিলিস্তিনি নেতারা অহিংস রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে দাবী আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ইনতিফাদা তথা গণ-অভ্যুত্থানের ডাক দেয়। দখলদার সাম্রাজ্যবাদের মোকাবেলায় সর্বোচ্চ প্রতিরোধ সংগ্রামকে আরবিতে ‘ ইন্তিফাদা’ বলা হয়।
ইয়াফার ইন্তিফাদা : ১৯২১
ইয়াফার ইন্তিফাদা সংঘটিত হয়েছিলো ফিলিস্তিনে বৃটিশ শাসনের প্রাক্কালে। বৃটিশ ভাইসরয়ের ইহুদি তোষণনীতি সাধারণ ফিলিস্তিনীদের মনে ক্ষোভের জন্ম দেয়। স্যমুয়েলের সেই নীতির প্রতিবাদ জানিয়ে সারা ফিলিস্তিনের জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। সেদিন ফিলিস্তিনীদের গণআন্দোলনের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় বৃটিশ সরকার।
বিক্ষুব্ধ জনতার রোষ থেকে বাঁচতে বৃটিশ সরকার জরুরি ভিত্তিতে টমাস হিক্রেপ্টে’র নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন গঠন করে। সেই তদন্ত রিপোর্টে ফিলিস্তিনিদের মাঝে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনের কারণ ও তার প্রতিকারে বাস্তবভিত্তিক সমাধানের প্রতি জোর দেওয়া হয়। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের অধিকার সুরক্ষা ও নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে বৃটিশ সরকারের প্রতি সুপারিশ করে তদন্ত কমিশন।
ইন্তিফাদা বুরাক : ১৯২৯
১৯২৯ সালের আগস্ট মাসে পবিত্র মসজিদ আল-আকসা’র বুরাক দেওয়াল ( আল-আকসা মসজিদের হেরেম এলাকার পশ্চিম দেওয়াল) নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা চালায় ইহুদি সন্ত্রাসীরা। ফিলিস্তিনিরা ইহুদিদের এই জঘন্যকর্মকে পবিত্র মসজিদ দখলের ষড়যন্ত্র গণ্য করে আল-আকসার পবিত্রতা ও স্বকীয়তা রক্ষার আন্দোলনে ফেটে পড়ে। সেই আন্দোলনে ইহুদি সন্ত্রাসীদের হামলায় ১১৬ জন ফিলিস্তিনি শাহাদাত বরণ করেন এবং হতাহত হোন অগণিত। বৃটিশ সরকার এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৩০ সালে লোকদেখানো তদন্তের জন্য Shaw Commission (শ কমিশন) গঠন করে।
সে তদন্তের রিপোর্টে দেখা যায়, বৃটিশ মেন্ডেটের ইহুদি তোষণনীতি ও প্রশাসনের উচ্চপদে ইহুদি পূনর্বাসনের ফলে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। কমিশন বৃটিশ সরকারকে পরামর্শ দেয়, ঘটনার স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করে “লীগ অব ন্যাশনে”র মাধ্যমে যেনো বিবাদমান উভয় পক্ষের মাঝে চলমান সংঘাতের দ্রুত সমাধান করা হয়।
ফিলিস্তিনের মহাবিপ্লব : ১৯৩৬-১৯৩৯
বৃটিশ সরকারের অব্যাহত দুঃশাসন ও ইহুদি সন্ত্রাসীদের চলমান আগ্রাসী আচরণ ফিলিস্তিনিদের জীবনকে বিষিয়ে তুলে। ফিলিস্তিনরা বৃটিশ দুঃশাসন থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে আবারও রাস্তায় নেমে আসে; ডাক দেয় সশস্ত্র-বিপ্লবের_ যা ইতিহাসে ১৯৩৬ সালের বিপ্লব বলে পরিচিত। এই বিপ্লব গোটা ফিলিস্তিনে ছড়িয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনের নারী-পুরুষ সকলে এই বিপ্লবে অংশ গ্রহণ করে। অপরাপর মুসলিম বিশ্ব ও স্বাধীনতাকামী জাতিগুলো ফিলিস্তিনের ন্যায্য আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন জানায়। বিপ্লবে টালমাটাল বৃটিশ সরকার ফিলিস্তিনি জনগণের পরপর বিপ্লবের কারণ নির্ণয় ও সুষ্ঠু প্রতিকারের লক্ষ্যে Peel Commission” পিল কমিশন” গঠন করতে বাধ্য হয়।
চলমান সংঘাত নিরসনে গঠিত কমিশন প্রস্তাব করে,
কুদস শহর, বেথেলহাম ও ইয়াফা অঞ্চলকে বেলফোর ঘোষণার বাহিরে রেখে ফিলিস্তিনের বাকি অংশকে আরব ও ইহুদিদের জন্যে আলাদা দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার।
শ্বেতপত্র : ১৯৩৯ সাল
ফিলিস্তিনরা পিল কমিশনের বাতানো “দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান” এর প্রস্তাবনা নাকচ করে দিলে সংঘাত আরও ঘনীভূত হতে থাকে। বিক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিদের আন্দোলন আবারও সহিংসতায় রূপ নেওয়ার আশঙ্কায় বৃটিশ সরকার বাধ্য হয়ে ১৯৩৯ সালের মে মাসে ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করে। সেই ‘শ্বেতপত্রে’ ফিলিস্তিন-ভাগের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে আরব ও ইহুদিদের জন্যে যৌথ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। কিন্তু স্বাধীন যৌথ ফিলিস্তিন-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন ছিলো। এরই মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ফিলিস্তিন সংকট প্রবেশ করে নতুন যুগে।
বাল্টিমোর সম্মেলন : ১৯৩৯
বৃটিশরা ফিলিস্তিন ভাগের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশ করলে দীর্ঘদিনের লালিত-স্বপ্ন ভঙ্গের আশঙ্কায় ঘাবড়ে যায় ইহুদি-নেতৃত্ব। বৃটিশ সরকারের ঘোষিত ‘শ্বেতপত্রে’র বিরোধিতা করে ১৯৪২ সালে নিউইয়র্কের বাল্টিমোর সম্মেলনে মিলিত হয় ইহুদিনেতৃবৃন্দ। সম্মেলনে ইহুদি-নেতারা বৃটিশ প্রশাসনের কাছে দাবি জানায় যে, ইহুদিদের প্রতি অব্যাহত সমর্থন বজায় রাখা, ফিলিস্তিন অভিমুখী অভিবাসন প্রত্যাশীদের উৎসাহিতকরণ, স্বতন্ত্র ইহুদি মিলিশিয়া গঠনের অনুমোদন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত একটি স্বাধীন ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে।
( উল্লেখ্য যে, বাল্টিমোর সম্মেলনকে দ্বিতীয় বেলফোর ঘোষণার সাথে তুলনা করা হয়। শ্বেতপত্র প্রকাশিত হলে জায়নবাদি নেতারা বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আশা হারিয়ে ফেলে। এজন্য স্বাধীন ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শরণাপন্ন হয়। শ্বেতপত্র প্রকাশের পর যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে না আসতো, তাহলে ফিলিস্তিনের বুকে হয়তো কখনো ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পারতো না জায়নবাদিরা। অনুবাদক)
ইতোমধ্যে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করায় বৃটিশরা পোল্যান্ডের সমর্থনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন বৃটিশরা ইহুদি মিলিশিয়াদের উন্নত প্রশিক্ষণসহ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করে রীতিমতো একটি পূর্ণ সামরিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলে। অপর দিকে তৎকালীন সময়ে ফিলিস্তিনদের উল্লেখযোগ্য কোনো মিলিশিয়া বাহিনী কিংবা সশস্ত্র সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল না৷
ইঙ্গ-মার্কিন কমিশন : ১৯৪৬
ফিলিস্তিনিদের চলমান স্বাধিকার আন্দোলনের পক্ষে আরব দেশগুলোর অব্যাহত সহযোগিতা চলতে থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটিশ সরকার যৌথ উদ্যোগে ইউরোপ ফেরত শরণার্থী ইহুদিদের সমস্যার সর্বোচ্চ সমাধানের কথা চিন্তা করে ফিলিস্তিন ইস্যুটি পুনর্বিবেচনার জন্য ১৯৪৬ সালে ইঙ্গ-মার্কিন কমিশন গঠন করে।
ইঙ্গ-মার্কিন কমিশনের প্রতিনিধিরা আরব ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে আরব ও ইহুদি উভয় পক্ষের ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহ করে রিপোর্ট পেশ করে। সেই ইঙ্গ-মার্কিন কমিশন সম্পূর্ণ শঠতার আশ্রয় নিয়ে ফিলিস্তিন ভাগের পরিকল্পনা থেকে সরে আসা ‘শ্বেতপত্র কমিশন’কে বাতিল করে দেয়। এবং ফিলিস্তিনে ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মৌলিক উপাদান হিসেবে ইহুদি জনসংখ্যা বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাব পেশ করে।
ফিলিস্তিন ভাগের প্রস্তাব : ১৯৪৭ সাল
ফিলিস্তিনের প্রতি আরব লীগের সহায়তা অব্যাহত থাকার ফলে ১৯৪৭ সালে ফিলিস্তিন ইস্যুটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ পর্যন্ত গড়ায়। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আল-কুদস ও বেথেলহেম শহরকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধীনে রেখে ফিলিস্তিনের বাকি অংশকে আরব ও ইহুদিদের মাঝে ভাগ করে আলাদা দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ইহুদিরা জাতিসংঘের প্রস্তাবিত ফিলিস্তিন ভাগের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও সমগ্র আরববিশ্ব প্রত্যাখ্যান করে। এদিকে জাতিসংঘে উত্থাপিত ফিলিস্তিন ভাগের প্রস্তাব বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ইহুদি সন্ত্রাসীরা ফিলিস্তিনের বিভিন্ন এলাকায় আরবদের বিরুদ্ধে গণহত্যা পরিচালনা করে; যার মধ্যে দীর ইয়াসিনের গণহত্যা অন্যতম।
ফিলিস্তিন যুদ্ধ : ১৯৪৮ সাল
বৃটিশ মেন্ডেটের ছত্রছায়ায় ইহুদিরা আরবদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। সর্বশেষ বৃটিশ মেন্ডেট অবসানের পর ১৯৪৮ সালের ১৪ মে স্বাধীন ইহুদিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন তড়িঘড়ি করে সেই অবৈধ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়। সেই ঘোষণার প্রতিক্রিয়া হিসেবে সম্মিলিত আরব সেনাবাহিনী দখলকৃত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ইহুদিরাষ্ট্রের উপর আক্রমণ করে বসে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, সেদিন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে থাকা সম্মিলিত আরব সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক চাপ ও অভ্যন্তরীণ নানান কারণে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। ইহুদিদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনকারী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটিশরা আরব সেনাবাহিনীকে ১৯৪৯ সালে সন্ধি-চুক্তিতে স্বাক্ষর করাতে বাধ্য করে।
সে থেকে ইহুদি ও খৃস্টানদের যৌথ ষড়যন্ত্রে নবীগণের পুণ্যভূমি ফিলিস্তিন জায়নবাদিদের দখলে চলে যায়। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের উপর নেমে আসে ইতিহাসের ভয়াবহতম জুলুম, নির্যাতন, হত্যা ও লুন্ঠন। আজও এই নির্মম ধারা অব্যাহত আছে।