ফ্রান্সে ফরাসি ভাষায়, সিরাত-প্রকল্পে মুসলিম গবেষকদের রচনাবলী সাধারণত দুটি খাতে প্রবাহিত হয়েছে—
এক – ইসলাম, রাসূল সা. এর পরিচয়, বিশ্বের প্রতি তাঁর অবদান, তাৎপর্য ও মহিমাকে প্রচার প্রসারের লক্ষ্যে বিদেশী ভাষাকে জরুরি মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের তাগিদ থেকে মুসলিম গবেষকগণ ফরাসি ভাষায় লেখালেখি শুরু করেন।
দুই – প্রাচ্যবিদদের সংশয়পূর্ণ লেখালেখির কাউন্টার হিসেবে। এবং ইসলাম সম্পর্কে জানার বিকল্প প্লাটফর্ম তৈরির জন্য এটি জরুরি ছিল বটে। এতে অত্যন্ত জোরালো ভাবে প্রাচ্যবিদদের আপত্তি ও অভিযোগগুলো নিয়ে আলাপ এসেছে।
এদুটি বিষয়ের বিবেচনায়, নানাবিধ কারণে নির্মলভাবে স্বীকার করতে হবে যে, ইংরেজির তুলনায় ফরাসি ভাষায় সিরাত চর্চা নিতান্ত কম হয়েছে। তবে এই সিরাত রচনার স্বল্পতাকে যদি বিদ্ধেষ ও নবি অবমাননার জন্য দায়ী করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে যে, এই মানসিকতা নিশ্চিত ভাবে ওয়ার অন টেররের ভুল পাঠ থেকে তৈরি।
প্রথমেই ফ্রান্সে মুসলিম গবেষকদের সিরাত চর্চা নিয়ে হালকা আলাপ করি। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম সামনে আসে মুহাম্মদ আসআদ বাঈ। তিনি “মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম” নামে ৩৩০ পৃষ্ঠার একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন, যা চারটি অধ্যায়ের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে তিনি প্রাক-ইসলামি আমল নিয়ে আলোচনা করেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ে এনেছেন রিসালাতের আলোচনা। তৃতীয় পর্যায়ে তিনি মদিনা ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। সবশেষে তিনি রাসুল সা এর মৃত্যু-পরবর্তী কালকে বিশ্লেষণ করেছেন। তবে তার এ বই পড়ে সহজেই বোঝা যায় যে, সিরাত রচনায় তিনি পদ্ধতিগত ভাবে প্রাচ্যবিদদের অনুসরণ করেছেন।
ড . জামালুদ্দিন ইবনুশ শায়খের লেখা কিতাব ‘মি’রাজুন নবি’। ইবনে আব্বাস রা. এর বর্ণিত মেরাজ সংক্রান্ত হাদিসকে বিশ্লেষণী ভঙ্গিতে তিনি পর্যালোচনা করেছেন। এ হাদিস কিভাবে সুফি-দর্শন কে প্রভাবিত করেছে এবং দান্তের মতো পশ্চিমা চিন্তকদের প্রতি-ক্রিয়াশীল করেছে, সেদিকেও ইশারা ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ফরাসি ভাষায় সবচে নির্মল ও বিশুদ্ধ রচনা উপহার দিয়েছেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ হায়দারাবাদি। ১৪২৪ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন। হিন্দুস্তানের হায়দারাবাদে জন্ম হলেও পরবর্তীতে তিনি হিজরত করেন প্যারিসে। বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য আবদার করলে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। সাতচল্লিশ সনে দেশবিভাগের পর পাকিস্তানে শরিয়া ভিত্তিক সংবিধান রচনার জন্য তাকে উপদেষ্টা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। তিনি ফরাসি ভাষায় ইসলাম চর্চার জন্য দৃঢ় সংকল্প নিয়ে ফ্রান্সে অবস্থান করেন। জগতের তাবৎ সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করে তিনি ইসলাম চর্চার শুরু করেন। ফলে তিনি রাসুল-জীবনের জরুরি সব অনুষঙ্গকে হাজির করেছেন – সার্বিক ভাবে। এক্ষেত্রে তাঁর দুই খন্ডে সমাপ্ত হওয়া গ্রন্থ ‘ইসলামের নবি’ দেখা যেতে পারে।
এছাড়াও ফরাসি ভাষায় রয়েছে তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ও নিবন্ধ। “ستة اصول لرسائل نبي الإسلام الدبلوماسية’ নামে একটি নিবন্ধ আছে , সেখানে তিনি কিছু তাৎপর্য-পূর্ণ টপিক নিয়ে আলাপ করেছেন–
১ . আরবি ভাষায় লেখালেখির ইতিহাস
২ . ডাক বিভাগের ইতিহাস
৩ . মুক্বাওকিস , হিরাক্বল, কিসরা ও বাহরাইনের শাসক মুনজিরের নিকট যেসব পত্র রাসুল সা. প্রেরণ করেছিলেন, সেসবের অথেনটিক ডকুমেন্ট তিনি হাজির করেছেন। এসব ডকুমেন্ট হালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লিখিত রচনাবলী বিভিন্ন ইলমি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। তাছাড়া নবিউল ইসলাম কিতাবেও তিনি এসব গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ নিয়ে আলাপ করেছেন।
ড. মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ সাহেব নাবিউল ইসলাম শিরোনামে, ভূমিকাতে একটি চমৎকার আলোচনা এনেছেন। কেন সিরাত অধ্যায়ন করতে হবে , এর প্রাসঙ্গিকতা কি – সিরাত পাঠের জরুরত নিয়ে আলাপ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি সিরাতের মৌলিক সুত্র সম্পর্কে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন যে, সিরাতে রাসুলের প্রথম সুত্র হচ্ছে কুরআন। দ্বিতীয় সুত্র সুন্নাহ। এছাড়া ইসলামি কবিতা, রাসুলের সা. জীবন নিয়ে লেখা অতি প্রাচীন গ্রন্থসমূহ ; উৎকৃষ্ট তিন প্রজন্মে যা কিছু রচিত হয়েছে সিরাতের উপর সেগুলোও সুত্র হিসেবে গণ্য হবে। সিরাত রচনার সময় যেসব মৌলিক সুত্রের প্রতি তিনি বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন, তার মধ্যে একটি হচ্ছে সিরাতে ইবনে ইসহাক। ইবনে ইসহাকের একটি কপি তিনি পুরানা কুতুবখানায় পেয়ে তাহকিক করে ছেপেছিলেন। ওয়াকেদির কিতাবুল মাগাযি, সিরাতে ইবনে হিশাম ও তবাকাতে ইবনে সা’দের উপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছেন। ড. মুহাম্মদ হামিদুল্লাহর সিরাত সম্পর্কীয় রচনাগুলো মৌলিক সুত্র না হলেও , তিনি গুরুত্বপূর্ণ অনেক দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ‘the introduction of Islam’ বইয়ে যেমন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদ আকারে বিষয় বিন্যস্ত করেছেন , নাবিউল ইসলাম কিতাবকেও সেই ছাঁচে সাজিয়েছেন। প্রথমে তিনি মক্কী জীবনে রাসুল সা. এর দাওয়াতি পর্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। পরবর্তীতে রাসুলের সা. মাদানি ও রাজনৈতিক জীবনের উপর বিশদ পর্যালোচনা হাজির করেছেন। রাসুলের সমরনীতি, পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে পত্র প্রেরণ, অন্যান্য কবিলা ও গোত্রের সাথে সন্ধি এবং ইহুদি খৃষ্টানদের সম্পর্কের খুঁটিনাটি নিয়ে আলাপ করেছেন। নাবিউল ইসলাম কিতাবের দ্বিতীয় খণ্ডে রাসুল সা. এর পারিবারিক জীবন, কুরআন সংরক্ষণের ব্যবস্থা, তা’লিম ও তরবিয়ত ব্যবস্থা নিয়ে আলাপ করেছেন।
ম্যাক্সিম রডিনসন (maxime Rodinson) ‘নবিউল ইসলাম’ বই সম্পর্কে লিখেছেন, “ড . মুহাম্মদ হামিদুল্লাহর সকল গ্রন্থে হুবহু বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় যে, তিনি ইসলামি জ্ঞানতাত্ত্বিক তুরাসের পাশাপাশি প্রাচ্যবিদ্যার জ্ঞানতত্ত্বের উপর অগাধ পারদর্শি – এ দুটির সম্মিলন খুব কম আলেমের মধ্যে পাওয়া যাবে। তাছাড়া বিশ্বাসের দৃঢ়তা নিয়ে, তীব্র সাহসিকতার সাথে কিভাবে তিনি প্রাচ্যবিদদের কাউন্টার দিচ্ছেন, তা অত্যন্ত তাৎপর্য-পূর্ণ। তাঁর সিরাত গ্রন্থটি অবশ্যই অন্যান্য গ্রন্থের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করবে।” (১)
একজন ফরাসি প্রাচ্যবিদ থেকে এরকম নির্মোহ স্বীকৃতি ড. মুহাম্মদ হামিদুল্লাহর প্রাসঙ্গিকতা নিশ্চিত করে দেয়।
মৌলিক রচনার বাইরে, সিরাত বিষয়ে ফরাসি ভাষায় অনূদিত গ্রন্থাদির সংখ্যাও কম না। অনূদিত গ্রন্থের অধিকাংশ আরবিতে লিখিত। আধুনিক ও প্রাচীন গ্রন্থাদি মিলিয়ে প্রায় বিশটির মতো। তা থেকে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে —
-কাজী ইয়াজ রহ. রচিত “الشفاء في حقوق المصطفى”
-ইবনুল কাইয়িম রহ. রচিত “زاد المعاد في هدي خير العباد”
-খিদরি বেক এর লেখা গ্রন্থ “نور اليقين في سيرة سيد المرسلين”
-মুহাম্মদ আল গাযালীর লেখা “فقه السيرة”
-সাঈদ রমজান আল বুতীর “فقه السيرة ”
-খালিদ মুহাম্মাদ খালিদের লেখা ” رجال حول الرسول”
ফ্রান্সে সিরাত-চর্চা : প্রাচ্যবিদদের প্রকল্প
ফ্রান্সে সিরাত ও ইসলাম চর্চার ইতিহাস নিয়ে যদি বলতে হয়, তাহলে গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। মধ্যযুগে ইসলাম যখন পুর্ব-পশ্চিমে তীব্র গতিতে প্রসার লাভ করছিল, কানিসার পাদ্রীরা তখন এ ধর্মের প্রতি মনোনিবেশ করে। এবং ইসলাম ও সিরাত চর্চা আরম্ভ করে। প্রথম দিকে ফ্রান্সে ইসলাম সম্পর্কীয় রচনাগুলো ল্যাটিন ভাষায় ছাপা হতো। যোশেফ শাখত তার “তুরাসুল ইসলাম” গ্রন্থে লিখেছে, ‘ফ্রান্সে প্রাচ্যবিদ্যার ধারণা সর্বপ্রথম সামনে আসে ১৭৯৯ সালে। তবে শব্দটি তাদের একাডেমিক পরিসরে আসে আরও পরে। ১৮৩৮ সালে।’ এই সময়টাতে পোপদের পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয় সিরাত-চর্চা। এ চর্চার একটি ঢং ছিল; সাধারণত ক্রুসেড যুদ্ধের পরাজয় থেকে সৃষ্ট প্রতিহিংসা সিরাত চর্চায় বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল। ফলে ইসলাম ও রাসুল সা. সম্পর্কে নানা রকম অপ্রীতিকর তথ্য পরিবেশন করা হয়। ঐতিহাসিক এ্যালন লিখেছেন যে, সিউফান নামের এক পাদ্রী সর্বপ্রথম, খৃস্টীয় নবম শতকে ইসলাম ও সিরাতে রাসুল সম্পর্কে ধারণা দিতে শুরু করে। পাদ্রী তার সেসময়ের প্রচারে বলে যে, ইসলাম হচ্ছে ইহুদি ঐতিহ্যের অংশ।’ এক্ষেত্রে ইমিল দিরমিঙ্গামের (Emile Dermenghem) ক্রিটিক গুরুত্বপূর্ণ, তিনি বলেছেন যে, এই পটভূমিতে পশ্চিমের সিরাত চর্চায় ক্রুসেড যুদ্ধের প্রভাব ক্রিয়াশীল ছিল।
সিরাত চর্চার এ পর্বটা ছিল বিদ্বেষে পূর্ণ। একটি নবাগত ধর্মের প্রাসঙ্গিকতাকে খাটো করবার প্রচেষ্টা হিসেবে বিভিন্ন রুপকথা ও মিথ্যাচার রটানো হয়েছিল ইসলাম সম্পর্কে। এ পর্বে ইসলামি জ্ঞানতাত্ত্বিক তুরাসের সুত্র অবলম্বন করে কোন রচনা বা বক্তব্য গড়ে উঠে নি। কারণ, আরবি ভাষার সাথে তখনও তাদের সম্পর্ক তৈয়ার হয় নি। ১৫৩৯ সালে “college de france” নামে প্যারিসের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম আরবি ভাষার একটি ফ্যাকাল্টি আরম্ভ হয়। এরপরে পোষ্টেল (postel) নামের এক প্রাচ্যবিদ সর্বপ্রথম আরবি ভাষা থেকে পাঠ ও আরবি সোর্স থেকে ইসলাম চর্চা শুরু করেন।
কিন্তু, অল্পকাল পরেই , ফরাসি বিপ্লব পরবর্তী সময়ে, সতেরো শতকে প্রাচ্যবিদ্যার নতুন এক সিলসিলা জারি হয়; যা মধ্যযুগের গির্জা কেন্দ্রীক ইসলাম চর্চা থেকে আলাদা। এবং সবচে বড় ব্যাপার ছিল যে, এই নতুন সিলসিলা স্বয়ং গির্জা ও পোপতন্ত্রের জন্যও ছিল অত্যন্ত ভয়ানক। এর প্রধান চালিকা শক্তি ছিল পশ্চিমা বস্তুবাদ ও ভোগবাদি দর্শন। শিয়া চিন্তক বাকের আস সদর তার বিখ্যাত গ্রন্থ “ফালসাফাতুনা” গ্রন্থে এই নতুন সিলসিলা জারি হওয়ার দুটি কারণ লিখেছেন–
ক . খৃষ্টীয় মন্ডলী যা বিশ্বাস করতো , তার মাহাত্ম্য তাদের অন্তরে থাকলেও সেসবের যুক্তি ও দর্শন সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল। ফলে পশ্চিমা চিন্তাধারা যখন যুক্তি ও দর্শনের সাথে উপস্থাপিত হতে শুরু করলো , ধর্মের বিরুদ্ধে যুক্তি হাযির করলো , তখন খৃস্টীয় ধার্মিক সম্প্রদায় নিজেদের বিশ্বাস নিয়ে সংশয়ে নিপতিত হলো।
খ . সেসময়ের সমাজ চিন্তক ও বিজ্ঞানীদের উপর চার্চের লোকেরা চরম নির্যাতন ও নিপীড়ন চালিয়েছিল। এবং গির্জার অধীনে একটি বিশেষ বাহিনী ছিল , যাদের হাতে অবাধ ক্ষমতা ছিল। তারা যে কাউকে অপরাধী করে শাস্তি দিতে পারতো। ফলে এক সময়ে, প্রতিবিধান হিসেবে বস্তুবাদীরা ধর্মের বিরোধিতা শুরু করলো। (২)
এই বিরূপ পরিবেশে প্রাচ্যবিদ্যার এই নতুন সিলসিলা শুরু হয়, যা একি সাথে গির্জা সহ সকল ধর্মের বিরুদ্ধে আক্রমণ আরম্ভ করে। ভলতেয়ার (voltaire) ছিল এই সিলসিলার অংশ। সে রাসুল সা. কে নিয়ে একটি রচনা লিখেছিল , যার নাম ‘মুহাম্মদ আও আত তাআসসুব’। সেখানেও সে বিদ্বেষের জায়গা থেকে বের হতে সক্ষম হয় নি। এই সময় থেকে পশ্চিমে ইসলাম চর্চার দুটি ব্লক তৈরি হয়েছে– একটির কেন্দ্রে ছিল গির্জা ও পোপতন্ত্র। অন্য ব্লকটির মুলে ছিল বস্তুবাদী চিন্তাধারা। দুটি ধারা থেকেই ইসলাম ও সিরাত চর্চার বহু নজির তৈরি হয়েছে। তবে এ কথা সত্য যে, দুটি ধারার মধ্যে বিপ্লোবত্তর বস্তুবাদী গবেষকগণ তুলনামূলক সৎ ছিলেন, সত্যনুসন্ধানী ও বাস্তবতার কাছাকাছি। বিশেষত সেসব গবেষক যারা গির্জার বৃত্তের বাইরে এসেছে এবং রাষ্ট্র থেকে ধর্মের বিচ্ছেদ ঘটিয়েছে।
সুতরাং, ফ্রান্সে প্রাচ্যবিদদের আমরা তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত পাই —
১. একদল ভারসাম্যপূর্ণ প্রাচ্যবিদ , যারা যথাসাধ্য আরবি মাসাদির থেকে তথ্য পরিবেশন করার চেষ্টা করেছেন। তবে এক্ষেত্রে কখনও ইনসাফ করেছে, আবার কখনও সততার পরিচয় দিতে পারে নি।
২. ধর্মান্ধ ও বিদ্ধেষী একদল প্রাচ্যবিদ, যারা সবসময় রাসুল সা. কে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় ব্যক্ত করেছে।
৩. তৃতীয় শ্রেণির যারা, তারা সাধারণত সৎ ও নির্মোহ। কিন্তু, কখনও কখনও ভুল বোঝাবুঝির কারণে অ-সঠিক কথা লিখেছে।
সামনে এসবের হালকা কিছু নজির নিয়ে পর্যালোচনা করবো।
অধিকাংশ প্রাচ্যবিদদের মধ্যে ইসলাম চর্চার প্রণোদনা তৈরি করেছে খৃষ্ট ধর্মীয় আবেগ। ফলে ইসলাম যেখানে খৃষ্টধর্ম ও এর পবিত্র সত্তাদের যেমন : যীশু ও মেরির প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল, সেখানে তাদের আচরণ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তারা বিদ্ধেষ নিয়ে মুহাম্মদ সা. এর সিরাত চর্চা করতো। এদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিল হেনরি ল্যামেন্স (Henri lammens)। যে বৈরুতের ইয়াসুইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির পন্ডিত ছিল, লেবাননে জীবন যাপন করেছে। ইসলাম ও সিরাতে রাসুল সা. এর উপর তার বেশকিছু অপলাপ ছিল; স্বয়ং অন্যান্য প্রাচ্যবিদরা তা প্রত্যাখান করেছে। গালিগালাজ, লা’নত ছিল তার বদভ্যাস। হযরত আয়েশা রাযি. এর উপর অপবাদ আরোপ করতো।
ফ্রান্সের অন্যান্য প্রাচ্যবিদরাও ল্যামেন্সকে মন্দ হিসেবে বিবেচনা করতো। প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ লুইস ম্যাসিনন (Louis massignon) লিখেছেন যে, ‘ল্যামেন্স কুরআনের সমালোচনা করতে যেয়ে যে কাঠামো তৈরি করেছে, তা যদি বাইবেলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতো, অবস্থা বেগতিক হয়ে যেত।’ মুসলিম ফরাসি প্রাচ্যবিদ নাসিরুদ্দীন দ্বীনিইয়াহ তার ‘আশ শরক ফি নযরিল গরব’ বইয়ে ল্যামেন্সের জবাব দিয়েছেন।
আদতে ল্যামেন্সের রচনাকে কোন ভাবেই জ্ঞান ভাবা যায় না। সম্পূর্ণ বিদ্ধেষ ও সাম্প্রদায়িকতা থেকে সে রাসূল সা. এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে। তার গোঁড়ামির কথা অনেকেই বলেছেন। যেমন : ফরাসি প্রাচ্যবিদ ম্যাক্সিম রডিনসন লিখেছেন যে, ল্যামেন্স ছিল একজন গোঁড়া। ইসলাম ও মুহাম্মদ বিদ্ধেষী। সে সাধারণত ইসলাম বিদ্বেষী প্রাচ্যবিদ গোল্ড জিহারের রচনাকে অনুসরণ করতো।
বোদি (body) হায়াতু মুহাম্মদ নামে গ্রন্থ লিখেছে। ফরাসি ভাষায় যা ‘la vie de muhammed’ নামে প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটি তিনি ১৬৭১ সালে লিখলেও তা পরিমার্জিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে ১৭৩০ সালে। প্রথম দিকে এই গ্রন্থকেই কেবল সিরাত জানার অবলম্বন হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তবে সমস্যা হচ্ছে, এ বইয়ে রাসুল সা. এর সিরাত পর্যালোচনার ক্ষেত্রে লেখক নির্মোহ ছিলেন না, ইনসাফ করতে পারেন নি।
বস্তুবাদী কিংবা মার্ক্সের অনুসারীদের মধ্যে সবকিছুকে অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতর থেকে বিবেচনা করার একটা প্রবনতা আছে। তারা ধর্মের মার্ক্সীয় ব্যাখ্যা হাযির করতে অভ্যস্ত। ইরানে আলি শরিয়তি এ কাজটি করেছে। তাছাড়া মার্ক্সীয় সাহিত্যে এগুলো এখন স্বাভাবিক প্রবনতা। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যাখ্যা হয়তো মাওলানা ভাসানীর হাতে সূচিত হয়েছে। পরবর্তীতে ফরহাদ মজহার ও পারভেজ আলমের মধ্যে এই ধরনের প্রবনতা খুব বেশি আছে। ফরহাদ মজহারের বিভিন্ন লেখায় এ প্রবনতা পষ্ট। পারভেজ আলমের দুটি বই বাজারে আছে —‘মদিনা’ নামে আর ইসলামের খিলাফত নিয়ে লেখা একটা বই। এছাড়া অন্যান্য মার্ক্সিস্টরা সুযোগ পেলে ধর্মের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা হাযির করার বাজে চেষ্টা করে।
ফ্রান্সের সিরাত চর্চার একাডেমিয়ায় এই ব্যাপারটা উপস্থিত ছিল। ম্যাক্সিম রডিনসন (maxime Rodinson) অনেক ক্ষেত্রে রাসুল সা. এর সিরাতের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা দেখানোর চেষ্টা করেছে। বিশেষত, ইসলামের যুদ্ধ নিয়ে সে বলেছে যে, মুহাম্মাদ সা . যেসব সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন , সেসব সমস্যা আদতে ধর্মীয় ছিল না। বরং অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল। আর ইসলামের সাফল্য এসেছে মুলত একটি রাষ্ট্র ও সভ্যতার সংকট থেকে। ইসলামের নবি যেহেতু অর্থনৈতিক সমস্যার নিরসন করতে সক্ষম ছিলেন এজন্য তার দাওয়াত সাফল্যের দেখা পেয়েছে।(৩) ম্যাক্সিম রডিনসন এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, ‘অনেক প্রাচ্যবিদ সিরাত বিষয়ে লেখার সময় মুহাম্মদকে সা. অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে ঠিক, যা আমি নিজেও করেছি আমার ‘মুহাম্মদ’ নামক গ্রন্থে। কিন্তু অন্যান্য প্রাচ্যবিদরা তাদের রচনায় যথার্থ ব্যাখ্যা হাযির করতে পারে নি। আমি মুহাম্মদের সা. মেধা, প্রতিভা ও মাহাত্ম্য দেখে তাজ্জব হয়ে গেছি। এবং তার যাবতীয় পদক্ষেপকে বস্তুবাদী নজরে দেখেছি। এবং এটিই যথার্থ হিসেবে মনে হয়েছে আমার।’
এখানে প্রাচ্যবিদদের রচনা থেকে প্রসিদ্ধ ও অল্প কিছু দেখানো হলো। এর বাইরেও প্রচুর রচনা আছে। বিশেষত, বিভিন্ন এনসাইক্লোপিডিয়া , ডিকশনারি এবং গবেষণা জার্নালে সিরাত সম্পর্কে তথ্য আছে। তাছাড়া বর্তমানে অনলাইনে ওয়েবসাইট আছে প্রচুর। সেসব সোর্সেও লেখালেখি হচ্ছে। সেখানেও ইতি ও নেতিবাচক অবস্থান প্রকাশিত হচ্ছে।
দিনশেষে প্রাচ্যবিদদের রচনার ক্ষেত্রে ড. ইমাদুদ্দিন খলিলের ক্রিটিক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন— এক. যখন একজন প্রাচ্যবিদ একদিকে ইসলাম ও সিরাত সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করছে। আবার অন্য জায়গায় নেতিবাচক অবস্থান যাহির করছে –এক্ষেত্রে তার ইতিবাচক মন্তব্যকে আমরা তার স্বীকারোক্তি হিসেবেই বিবেচনা করবো।
দুই . কোন প্রাচ্যবিদের লেখায় রাসুল সা. সম্পর্কে প্রশংসা ও স্তুতি দেখেই তাকে মুনসিফ বা ভারসাম্যপূর্ণ ভাবার কোন সুযোগ নেই। বরং তার সকল রচনা ও আচরণের দিকে সুক্ষ নজর রাখতে হবে। তারপর বিচার করতে হবে। কারণ, অনেকে প্রশংসা ও স্তুতিকে মুসলিমদের কাছে আস্থাশীল ও নির্ভরযোগ্য হবার হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। (৪)
কিছু ভারসাম্যপূর্ণ প্রাচ্যবিদদের রচনা :
ইমিল দিরমিঙ্গাম (Emile Dermenghem) একজন প্রখ্যাত ফরাসি প্রাচ্যবিদ। ১৮৯২ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ইসলামের নির্মলতা ও সাম্যে বিমুগ্ধ হয়েছিলেন, ইসলাম ও সিরাতে রাসুল সম্পর্কে আর্টিকেল সহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ তিনি লিখেছেন। তবে প্রাচ্যবিদ্যার চিরায়ত চিত্রের বাইরে এসে তিনি জ্ঞানতাত্ত্বিক সততার নজির তৈরি করেছেন , নিকট অতীতে। প্রাচ্যবিদ্যার ইতিহাসে তার লিখিত বই ‘হায়াতু মুহাম্মদ ফি উয়ুনি মুস্তাশরিকিন’ একটি তাৎপর্য-পূর্ণ সূচক হিসেবেই বিবেচিত হবে। বইটি ১৯২৯ সালে ছাপা হয়। এটি আরবিতে অনুবাদ করেছেন ‘আদিল যাঈতার’। তার রচিত ‘মুহাম্মদ ওয়াস সুন্নাতুল ইসলামিইয়া’ ১৯৫০ সালে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ‘আশ শাখছিইয়াতুল মুহাম্মাদিইয়া’ লিখেছেন তিনি। পরবর্তী বই দুটিও আরবিতে অনুবাদ করেছেন আদিল যাঈতার।
সিরাত নিয়ে ইমিল দিরমিঙ্গামের লেখা ‘হায়াতু মুহাম্মদ’ বইটির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আছে। যেসব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকতার সাথে উল্লেখ করা জরুরি। কারণ ফ্রান্সে অন্য যারাই রাসুলের সা . জীবন নিয়ে আলাপ করেছে , সততার সাক্ষর রাখতে পারে নি। এই অ-সততার ক্ষেত্রে নানামূখী কারণ হাযির ছিল। অধিকাংশের মধ্যে বিদ্ধেষ, জ্ঞানস্বল্পতা, মৌলিক ভাষার ক্ষেত্রে দৈন্য ও অন্যান্য অসৎ ওরিয়েন্টালিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত হবার দোষ আছে। এদের প্রসিদ্ধ কয়েকজন হচ্ছে, দিকুবির, ব্রিমার, গোল্ড জিহার প্রমুখ।
এখানে ইমিল দিরমিঙ্গামের ‘হায়াতু মুহাম্মদ’ বইটির একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা তুলে ধরা হলো—
১. তিনি যথাসাধ্য মৌলিক সুত্র ঘেঁটে তথ্য পরিবেশন করার চেষ্টা করেছেন। এবং পশ্চিমা ওরিয়েন্টালিস্টদের ভন্ডামি ও ধূর্ততা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকে সিরাতের পর্যালোচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমি এ গ্রন্থ রচনার মধ্যে দিয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি সিরাত সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে। এবং এক্ষেত্রে সিরাতের অতি প্রাচীন গ্রন্থাদি থেকে সহায়তা নিয়েছি। এসব করতে গিয়ে হালের রচনার ব্যাপারে উদাসীন ছিলাম না মোটেও। কিতাব ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মননে সিরাতের যে চিত্র অঙ্কিত আছে , সেসবের প্রতি প্রাসঙ্গিক বিবেচনা করেছি। (৫)
২. ইমিল দিরমিঙ্গাম অন্যান্য অসৎ ওরিয়েন্টালিস্টদের ভন্ডামি তুলে ধরেছেন তার বইয়ে , সমালোচনা ও পর্যালোচনা করেছেন সেসব বক্তব্যের। তিনি বলেন যে , ” ইসলাম সম্পর্কে বিদ্ধেষ ও বিকৃতির ইতিহাস দীর্ঘদিনের। সেই রুডলফ ডুলোডহিম (Ruḍalpha ḍulōḍahima) থেকে শুরু করে নিকোলাস ডকুজ ও মার্চি পর্যন্ত যে , ইসলাম একটি খোদাদ্রোহী , ভ্রষ্ট ধর্ম। এর অনুসারী বন্য, উচ্ছিন্ন। কুরআন বাতিল কথায় পরিপূর্ণ। “(৬)
ইমিল দিরমিঙ্গাম এসব অপবাদের বিরোধীতা করে বলেন যে, “রাসুলের জীবনচরিত থেকে পষ্ট বুঝে আসে , তিনি একটি মহান আমানতকে ধারন করতেন। তাঁর ব্যাপক প্রজ্ঞা, দূরদৃষ্টি, আত্মসংযমের দারুণ ক্ষমতা ও চমৎকার পরিচালনা এবং কর্ম-চাঞ্চল্য প্রমাণ করে যে তাঁর উপর অবতীর্ণ বিষয়গুলো বেহুদা বাতুলতা নয়।(৭)
এছাড়াও রাসুলের জীবনচরিত যে চিরায়ত ওহির অবিচ্ছেদ্য অংশ, পরিবর্তনবাদী সমাজের রুপকল্প , তার সরল স্বীকৃতি তিনি দিয়েছেন। মু’জিযার যথার্থতা সাবিত করেছেন। তবে একথা সত্য যে, ইমিল দিরমিঙ্গাম তার সততা সত্বেও কিছু জাযগায় ভুলের শিকার হয়েছেন, যা নবুয়তের মানসিবের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এছাড়া আরও আছে رجيس بلاسدشسر এর লেখা কিতাব “معضلة محمد”। তিনি এতে আরবি ভাষার মুল সুত্র থেকে তথ্য পরিবেশন করেছেন। এবং ঘটনা বর্ণনার ক্ষেত্রে সময় ও সনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছেন। তবে তার রচনাতেও হালকা কিছু ভুল বিকৃতি ও সংশয়পূর্ণ বিষয় আছে। “ফি খুতা মুহাম্মদ” নামে আরেকটি বই আছে তার।
Rozer Arnaldez এর লেখা ‘মুহাম্মদ’ গ্রন্থটিকেও ভারসাম্যপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি এখানে দুটি আঙ্গিকে সিরাত অবতারণা করেছেন- ১ . নবি জীবনের ঘটনাবলীকে সাল ও সনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে বিবরণ করা। ২ . হাদিসে উল্লেখিত সিরাত বিষয়ক তথ্য উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে।
ইমিল দিরমিঙ্গাম সহ এইসব ভারসাম্যপূর্ণ প্রাচ্যবিদদের অবস্থান অন্যান্য ফরাসিদের জন্য ইউটার্নের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ভাবিয়েছে যে, এদেশের মাটিতে, আমাদের রক্তে মাংসে বেড়ে ওঠা সন্তান কিভাবে ভিন্ন মূল্যায়ন হাজির করছে! তারচে বেশি পীড়াদায়ক ছিল প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ নাসিরুদ্দীন দ্বীনিইয়াহর ইসলাম গ্রহণ।
যতদূর জানি, নাসিরুদ্দীন দ্বীনিইয়াহ হচ্ছেন একমাত্র ফরাসি প্রাচ্যবিদ যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসুল সা. এর জীবনী লিখেছেন, হজ্জ সহ ইসলামের মৌলিক কিছু বিষয় নিয়েও তিনি লিখেছেন। বাংলাদেশে, শাহবাগী বুদ্ধিজীবিতার একটি বিশেষ চরিত্র আমরা সেই ষাটের দশক থেকে প্রত্যক্ষ করছি। নিজের কল্পিত, পূর্বানুমানকৃত ধারণা ও বৃত্তের বাইরের জ্ঞানচর্চাকে ঠিক ভাবে নেবার যোগ্যতা এদের পূর্বে যেমন ছিল না। আজও গড়ে উঠে নি। কবি আল মাহমুদকে ঘরকুনো করে তাই প্রমাণ করেছে তারা। দিনশেষে বাংলাদেশের শাহবাগী বুদ্ধিজীবি আর ফরাসি ওরিয়েন্টালিস্টরা জ্ঞানতাত্ত্বিক শঠতা ও দুর্বৃত্তপনায় কিভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ; নাসিরুদ্দীন দ্বীনিইয়াহ নিঃসন্দেহে পষ্ট একটি মেছাল।
নাসিরুদ্দীন দ্বীনিইয়াহ যখন বৃত্তের বাইরে গিয়ে রাসুলের সা. সিরাত রচনা করলেন , ফ্রান্সে প্রাচ্যবিদদের লেখা রচনা ও জ্ঞানতত্ত্ব থেকে বিমুখ হয়ে সিরাতে ইবনে হিশাম ও তবাকাতে সা’দের মতো প্রাচীন কিতাবাদিকে সুত্র বানালেন , তখন তারা উন্মাদনা আরম্ভ করেছিল। ঠিক একালের শাহবাগী বুদ্ধিজীবিদের মতো।
নাসিরুদ্দীন দ্বীনিইয়াহ বলেন যে, ” সিরাত রচনা দীর্ঘ প্রচেষ্টার একটি অংশ। নবি জীবনের সকল অনুষঙ্গ পূর্ণাঙ্গরুপে হাজির করার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে, অতি জরুরি দিকগুলো তুলে ধরা। আমি আমার এ সিরাত-গ্রন্থে , তথ্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইবনে হিশাম ও ইবনে সা’দের মতো প্রবীণ লেখকদের উপর নির্ভর করেছি। আলি ইবনে বুরহানুদ্দীন হালাবির ‘আস সিরাতুল হালাবিইয়া’কে অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভরতার কেন্দ্রে রেখেছি। (৮)
ওরিয়েন্টালিস্টদের কাউন্টারে রচিত অন্যসব বইয়ের মতো তার বইয়েও তিনি প্রাচ্যবিদদের আপত্তি ও অভিযোগ নিয়ে সযত্নে আলোচনা করেছেন। বিশেষত, তিনি যেহুতু স্বদেশীদের রাসুল বিদ্বেষের আকর সম্পর্কে জানতেন , ফলে সেসবের কাউন্টার গুরুত্বের সাথে করেছেন। এজন্য, ইমিল দিরমিঙ্গামের মতো তার রচনাও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হিসেবে বিবেচিত হয়। নাসিরুদ্দীন দ্বীনিইয়াহ বিদ্ধেষীদের কাউন্টারে লিখেছেন, ‘এ কথা কিভাবে বলা হচ্ছে যে, কদরের প্রতি বিশ্বাস মুসলিমদের কর্মচাঞ্চল্য নষ্ট করে দেয়। অথচ রাসুল সা. ছিলেন সবচে কর্মতৎপর ও প্রাণবন্ত। ইসলাম একমাত্র ধর্ম , যা তার উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে আশ্চর্যজনক সাফল্য, বিজয় ও সমৃদ্ধ সভ্যতার নজির তৈরি করেছে। ইসলাম শব্দ আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টির প্রতি নির্দেশ করে। মুসলিমদের এ আকিদাই যাবতীয় দুর্বলতা থেকে তাদের মুক্ত রাখে। প্রবল শক্তিমত্তার সঞ্চার করে ; সে যাবতীয় বিপদ ও দুর্ভোগ সহ্য করতে সক্ষম হয়। (৯)
নাসিরুদ্দীন দ্বীনিইয়াহ ছাড়া আরও অনেকে ইসলাম ও সিরাতে রাসুলের প্রতি মুগ্ধ হয়ে ইসলাম কবুল করেছেন। কিন্তু, তারা স্বতন্ত্র রচনা লিখে যান নি। ইসলাম ও নবি জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রবন্ধ নিবন্ধ লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মনসুর মুনতাই (mansour monteil)। তিনি the Islam বইয়ে সিরাত নিয়ে হালকা আলাপ করেছেন। লর্ড হাডলি কায়রোর ক্যাথলিক পরিবারের লোক ছিলেন। তিনিও ফরাসি ভাষায় সিরাত সম্পর্কে প্রবন্ধ লিখেছিলেন।
তথ্যসূত্র :
১ . আল ইহতেমাম বিস সিরাহ ফিল লুগাতিল ফ্রেনসিইয়া , পৃ. ১৫
২ . ফালসাফাতুনা , বাকের আস সদর পৃ. ১৫
৩ . মুহাম্মদ, ম্যাক্সিম রডিনসন পৃ. ১১০
৪ . ক্বালু আনিল ইসলাম (ভুমিকা) , ড. ইমাদুদ্দিন খলিল পৃ. ৮
৫ . হায়াতু মুহাম্মদ, ইমিল দিরমিঙ্গাম, পৃ. ৯৩
৬ . প্রাগুক্ত, পৃ. ১১৭
৭ . প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৪
৮. La vie de Mohammed, নাসিরুদ্দীন দ্বীনিইয়াহ
৯ . প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৭