প্রথম কথা
বাংলা ভাষায় রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ বিষয়ক এটিই প্রথম রচনা। ইতোপূর্বে যেসব মূল্যবান গ্রন্থ ও রচনা প্রকাশিত হয়েছে এবং এখনো যা হচ্ছে, সবই মৌলিকভাবে প্রাচ্যবাদ কেন্দ্রিক। রাশিয়ান প্রাচ্যবাদী ধারার কোনো আলোচনা স্বভাবতই অনুপস্থিত সেসবে। ফলত এ রচনাটিকে বাংলা ভাষায় মৌলিক অনূদিত সব দিক থেকেই একেবারে প্রথম প্রাচ্যবাদ সংক্রান্ত রচনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়। রচনাটি লিখতে গিয়ে প্রধানত এ বিষয়ক আরবি সংকলনগুলোকে সামনে রাখা হয়েছে। এর বাইরে তুর্কি ও ইংরেজি উৎসমালা থেকেও সাহায্য নেওয়া হয়েছে প্রচুর। রচনাটি পাঠককে অন্বেষার এমন এক দরজায় এনে দাঁড় করাবে, যার ওপারেই অপেক্ষা করছে আমাদের হাজার বছরের হারানো উত্তরাধিকার। নাতিদীর্ঘ রচনাটির প্রথম পর্ব উপস্থাপন করা হলো আল আযহার ব্লগের পাঠকদের জন্য।
রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ: ঐতিহাসিক পাঠ
প্রাচ্যবাদকে বলা হয় এমন তরবারি, যার দুদিকেই ধার। সে তরবারি কখনো আমাদের পক্ষে ব্যবহৃত হয়েছে, কখনো বিপক্ষে। আমরা যারা প্রাচ্যের, আমাদের জ্ঞান বিজ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতিকে যখন পাশ্চাত্যে নিয়ে যাওয়া হয়েছে জ্ঞাননিষ্ঠ চর্চার জন্য, সভ্যতার উন্নয়নের জন্য, তখন সেটা ব্যবহৃত হয়েছে আমাদের কল্যাণে। যেমনটা করেছেন এডওয়ার্ড সাঈদের মত অনেক সত্যপ্রিয় প্রাচ্যবিদ। প্রাচ্যকে চর্চা করে পাশ্চাত্যকে তারা জানিয়েছেন, তাদের জাগরণের মূলে ছিল প্রাচ্যের অনুদান। প্রাচ্যের বিশেষত আরবের সভ্যতার আলো নিয়ে ইউরোপ তার উত্থান নিশ্চিত করেছে। স্পেন, সিসিলি আর এশিয়া মাইনরের দরজা দিয়ে সর্বপ্রথম ইসলামি ও আরব্য আলোর সলতে প্রবেশ করেছিল পশ্চিমে। সেই সলতে দিয়ে কয়েক শতাব্দি পর মধ্যযুগীয় অন্ধকার ইউরোপে সভ্যতার আলো বিচ্ছুরিত হয়েছে ঝলমল করে।
আরবি ও ইসলামি সভ্যতার এই প্রাণশক্তিকে অনেকে যেভাবে স্বীকার করেছেন অকপটে, তেমনি অস্বীকার করেছেন অনেকে। বরং তারা একে বিকৃতরূপে উপস্থাপন করেছেন পাশ্চাত্যের কাছ। শুধু তাই নয়, এক সময় তারা জ্ঞানের এই ধারাকে তুলে দিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে। যারা একে ব্যবহার করেছে শোষণ, কর্তৃত্ব আর দখলদারিত্বের বুদ্ধিবৃত্তিক হাতিয়ার হিসেবে।
তবে আমাদের কাছে প্রাচ্যবাদ বলতে সাধারণত পশ্চিমা প্রাচ্যবাদ মনে হলেও এর বাইরেও আছে প্রাচ্যবাদের ভিন্ন ধারা। রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ সেই ধারাগুলোরই অন্যতম। সাধারণ পশ্চিমা প্রাচ্যবাদের সাথে আদর্শ ও নীতিতে, লক্ষ ও কর্মপন্থায় রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের রয়েছে মোটাদাগের পার্থক্য। এই রচনায় আমরা রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের মৌলিক জরুরি আলাপগুলো তুলবো।
রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ বিষয়ক রচনাবলি
প্রাচ্যবাদ নিয়ে লেখাজোখা কম হয় নি মোটেও। রাজনৈতিক স্বার্থে প্রাচ্যবাদ কেন্দ্রিক গবেষণায় পশ্চিমারা সাধ্যের সবটুকু ব্যয় করেছে। ফলে এ নিয়ে তৈরি হয়েছে রচনার সুবিশাল ভাণ্ডার। তবে সে সব রচনা ঘুরেফিরে একই স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে। কারণ, তাদের সব রচনাই ছিল পশ্চিমা প্রাচ্যবাদ কেন্দ্রিক গবেষণা। রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ নিয়ে কোনো আলোচনা সেসবে ছিল না। আরব ও প্রাচ্যীয় গবেষকরাও সেসব নিয়ে আলোচনা করেছেন কম। তার কারণও আছে অবশ্য। যেমন—
- – পশ্চিমা বিশ্বের সাথে আরব বিশ্বের ভৌগোলিক নৈকট্য ছিল বেশি। বলতে গেলো একমাত্র ভূমধ্যসাগর ছাড়া কোনও দূরত্ব তাদের মাঝে ছিল না। ভৌগোলিক এ নৈকট্য প্রাচ্য নিয়ে গবেষণার পথকে করেছে সহজ । যা রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের ক্ষেত্রে ছিল অনুপস্থিত।
- – ক্রুসেডের মধ্য দিয়ে সংঘটিত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের যোগাযোগ। যখন প্রথমবারের মত সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিনে ধর্মযুদ্ধ যোগ দিতে এসে পশ্চিমারা প্রাচ্যকে নিকট থেকে দেখেছিল। সে তুলনায় রাশিয়ানদের প্রাচ্যভ্রমণ ছিল আরও অনেক পরে।
- – বিভিন্ন সাগর ও জলপথের কারণে আরবের সাথে পশ্চিমের ছিল সহজ সংক্ষিপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা। যা রাশিয়ার ক্ষেত্রে ছিল না।
- – পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের গবেষণার অনুবাদ ছিল সহজ, সহজলভ্য। ফরাসি, ইংরেজি ও ডাচ ভাষা থেকে অনায়াসেই পাওয়া যেত সেসব। বিপরীতে রাশিয়ান প্রাচ্যবাদী গবেষণার অনুবাদ ছিল নিতান্ত দুর্লভ। কারণ, রাশিয়ার ভাষা ছিল কঠিন।
- – তাছাড়া রাশিয়ান প্রাচ্যবাদী আলোচনাগুলোকে গবেষকরা প্রথম দিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেন নি বলে সেগুলোর অনুবাদেরও প্রয়োজন অনুভব করেন নি। এসবের বাইরে, সে সময় আরব ও মুসলমানদের কেন্দ্রীয় খেলাফত উসমানি সাম্রাজ্যের সাথে রাশিয়ার টানাপোড়েনের সম্পর্কের কারণে রাশিয়াবিরোধী মানসিকতা কাজ করত আরব ও প্রাচ্যীয় মানসে।এসব কারণেই মূলত রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ সম্পর্কে জানাশোনা ও তথ্যপ্রাপ্তির ঘাটতি তৈরি হয়েছে।¹
পরবর্তীতে একটা পর্যায়ে এসে সর্বপ্রথম রাশিয়ান প্রাচ্যবিদদের রচনা নিয়ে দুটি গবেষণা প্রকাশিত হয়। একটি ছিল লেবানিজ বংশোদ্ভুত রুশ চিন্তাবিদ সুহায়ল ফারাহ এর (Сухейль Фарах) (১৯২৪–বর্তমান)। তার গবেষণার আলোচ্য ছিল, রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের উৎপত্তি ও এর ক্রমবিকাশের নানা পর্যায়। ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত হয় গবেষণাটি। এ গবেষণায় তিনি রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের উৎপত্তি ও ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পূর্ব পর্যন্ত এর ক্রমবিকাশের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
আর দ্বিতীয় গবেষণাটি ছিল রাশিয়ান প্রাচ্যবিদ গ্রেগরি শর্বাতভের (Grigory Shcherbatov) (১৯২৪–২০০৬)
তার আলোচনার শিরোনাম ছিল— ‘১৯১৭ থেকে ১৯৫৯ সময়কালে সোভিয়েত ইউনিয়নে আরববাদ’। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত হয় রচনাটি। এ রচনায় তিনি ১৯১৭ এর অক্টোবর বিপ্লব পরবর্তী সময় থেকে রাশিয়ার আরব ও প্রাচ্যকেন্দ্রিক গবেষণার ইতিহাস তুলে এনেছেন। প্রাথমিক এ রচনাদুটির পর রাশিয়ান প্রাচ্যবিদ বিষয়ক সংকলনের ধারাবাহিকতা শুরু হয়ে যায়।²
কিন্তু সেসব রচনার বড় অংশেই প্রাচ্যকে অংকিত করা হয় এমন দৃশ্যে। যা আসলে প্রাচ্যের নয়। আবার অনেক রচনায় প্রাচ্যের মৌলিক বিষয়গুলোকেও রাখা হয় অনুপস্থিত। শুধু তাই নয়, রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইসলামের বিরুদ্ধে অন্ধ জাতীয়তাবাদ ও জাতিবাদকে উস্কে দেওয়া হয় পরিকল্পিতভাবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, প্রাচ্যকে নিয়ে আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ইসলামি প্রাচ্যকে নিয়ে রাশিয়ার মূল টানাপোড়েন কোথায় ছিল? কেন তারা ইসলামি প্রাচ্যকে নিয়ে গবেষণায় লিপ্ত হলো? সে আলোচনা আমরা এখানে করবো। তবে তার আগে ইসলামের সাথে রাশিয়ার সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি কী ছিল, জানতে হবে তা নিয়ে।
রাশিয়া ও ইসলাম : মুখোমুখি অতীত
৩১১ খৃষ্টাব্দে সম্রাট কনস্টান্টিনের ইতালির রোম দখলের মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে প্রথম খৃষ্টধর্ম বিস্তার লাভ শুরু করে। এর আগে তারা মূর্তিপূজা, গোত্রবাদ ও আঞ্চলিক নানা আদর্শে জীবনধারণ করতো। তবে তখনো পূর্ব ইউরোপে খৃষ্টধর্ম পৌঁছে নি।³ ফলে পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশের মত রাশিয়াতেও জীবনধারার আঞ্চলিক নানাপ্রথা— মূর্তিপূজা ইত্যাদি বিদ্যমান ছিল। পরবর্তীতে পূর্ব ইউরোপে খৃষ্টধর্ম ছড়িয়ে পড়লেও রাশিয়ায় তা পৌঁছতে ৯৮৮ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সময় লাগে। এ সুদীর্ঘ সময় জুড়ে রাশিয়ায় মূর্তিপূজার প্রচলন বলবৎ ছিল। রাশিয়ার অঞ্চলগুলোতে অতিমাত্রায় শৈত্য প্রবাহের কারণে মূলত সেখানে প্রাচীন বিশ্বের যোগাযোগ ছিল কম। আর সে কারণেই নতুন কোনো মতাদর্শ সেখানে হাজির হতে পারে নি সহজে।
৯৮৮ খৃষ্টাব্দে রাশিয়ার শাসক প্রথম ভ্লাদিমির (Володимѣръ Свѧтославичь) (৯৫৬–১০১৫ খৃ.) খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। সে সময় পুরো সাম্রাজ্যে খৃষ্টবাদকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ওই সময়টা ছিল ইসলামি জাগরণের স্বর্ণযুগ। দিকে দিকে পৃথিবীর কোণায় কোণায় ইসলামের অব্যাহত বিজয় অভিযান চলতে থাকে। কোথাও যুদ্ধ আর কোথাও শান্তির মধ্য দিয়ে ইসলাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে খৃষ্টবাদের অধীনে থাকা শাম থেকে রোম পর্যন্ত। অন্যদিকে পশ্চিম ইউরোপেও আন্দালুসের দরজা দিয়ে ইসলাম প্রবেশ করে। তবে ইসলামের এসব বিজয় অভিযানের নাগালের বাইরে থেকে যায় রাশিয়া। কারণ, ভৌগোলিক দিক থেকে রাশিয়া ছিল খুবই দূরবর্তী ভূখণ্ড। তাছাড়া, রাশিয়া সেসময়ে ‘কীফ’ নামের সাধারণ এক জনপদের বাইরে কিছু ছিল না।⁴
ফলে রাশিয়ার বাইরে প্রাচীন দুনিয়ার প্রায় সব অংশেই ইসলাম আপন উপস্থিতির জানান দিতে থাকে। এমন প্রেক্ষাপটে অস্তিত্বের সংকটে পড়ে খৃষ্টবাদ। খৃষ্ট ধর্মগুরু ও পণ্ডিতরা তাই বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে ইসলামবিরোধী প্রচারণা শুরু করে। প্রস্তুতি নিতে থাকে তথাকথিত ধর্মযুদ্ধের। সে ধারাবাহিকতায় একদল খৃষ্টান ধর্মগুরু রাশিয়ার সম্রাটের নিকটে গিয়ে পৌঁছে। তারা সম্রাটকে ইসলামের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে খৃষ্টবাদ গ্রহণের আহ্বান জানায়। সম্রাট তাদের আহ্বান কবুল করে খৃষ্টবাদে দীক্ষিত হয়।⁵
তারপর ইতিহাস তরতর করে বয়ে চলে সমুখের দিকে। খৃষ্টীয় এগারো শতকে পুরো ইউরোপের সবচেয়ে প্রাতাপশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয় রাশিয়া। রাশিয়া সে সময় তার ইতিহাসের দ্বিতীয় পরিক্রমা পার করছে। বাল্টিক সাগর থেকে নিয়ে কৃষ্ণ সাগরে তখন রাশিয়ার একচ্ছত্র অধিকার। এমন প্রেক্ষাপটে ইসলামের বিরুদ্ধে খ্রিষ্টানদের তথাকথিত ধর্মযুদ্ধেও নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়ে যোগ দেয় রাশিয়া।
তারপর পনেরো শতকের মধ্যভাগে যখন রাশিয়ার ইতিহাসের তৃতীয় পরিক্রমা চলছে, রাশিয়া তখন নানা জাতি ও ভূখণ্ড দখল করে বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছে। সম্রাট ইভান রাহিবের (Ivan the Terrible:1462–1505) শাসনকালে রাশিয়ান সাম্রাজ্য শক্তির চূড়ায় অবস্থান করে। এই সময়ে এসে উসমানি সাম্রাজ্য ও ব্যাপকভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে রাশিয়ার দ্বন্দ্ব সংঘাত চলতে থাকে। ১৪৮০ সালে রাশিয়া মোঘল মুসলমানদের উরতা যাহাবি সাম্রাজ্য (১২৪০–১৫০২) ধ্বংস করে দেয়। এরপর ১৫৫২ সালে কাযান সাম্রাজ্যেও (Qazan Xanlığı: 1438–1552) আক্রমণ করতে শুরু করে করে। এক পর্যায়ে শহর দখল করে এখানকার অধিবাসীদের নির্বিশেষে জবাই করে হত্যা করে। ১৫৫৬ সালে আস্ত্রাখান শহরকে রাশিয়ার অধিভুক্ত করা হয়। (Astrakhan : বর্তমানে রাশিয়ার দক্ষিণে অবস্থিত ভোলগা নদীর তীরবর্তী একটি শহর)। আর সে সময় থেকে মধ্য এশিয়ার সবগুলো দেশে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার বুনিয়াদ রচনা করে রাশিয়া।⁶
রাশিয়ার দখলকৃত এ সবগুলো রাজ্য ছিল বিভিন্ন আঞ্চলিক মুসলিম সাম্রাজ্য। এমন প্রেক্ষাপটে তৎকালীন উসমানি সাম্রাজ্যের সাথে বিরোধ বাড়তে থাকে রাশিয়ার। ধীরে ধীরে তা দুই পক্ষের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে রূপ নেয়। ১৭৬৮– ১৭৭৪ এর প্রথম যুদ্ধে রাশিয়া উসমানিদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় ক্রিমিয়া উপদ্বীপ। এরপর সংঘটিত হয় আরো ভয়ংকর পাঁচটি যুদ্ধ। সেগুলোতেও হারে উসমানি সাম্রাজ্য। এই ধারাবাহিক পরাজয়ের ফলে ধীরে ধীরে পুরো বলকান হাতছাড়া হতে শুরু করে উসমানিদের। এক পর্যায়ে উসমানি সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে সংখ্যালঘু খৃষ্টানদের অধিকার আদায়ের মিথ্যা অজুহাতে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্য এশিয়ায় আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। আস্তে আস্তে ককেশিয়া ও আজারবাইজানও দখলে নেয় রাশিয়া। আঠারো শতকের মধ্যভাগে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতে থাকে নাটকীয়ভাবে। এ সময় রাশিয়ার আন্তর্জাতিক খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। ধীরে ধীরে পরাশক্তির রূপ নিয়ে আবির্ভূত হতে শুরু করে রাশিয়া। এরইমধ্যে সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া উসমানি সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা বলকান ও ককেশিয়া অঞ্চলসহ প্রাচ্যের মুসলিম ভূখণ্ডগুলোর বড় অংশই দখল করে নিয়েছে। একদিকে মধ্য এশিয়ার সবগুলো স্তান রাষ্ট্র অন্যদিকে ককেশিয়া থেকে নিয়ে পূর্ব ইউরোপ পুরোটাতেই ছিল রাশিয়ার আগ্রাসন। সাম্রাজ্যের অন্তর্গত বিশাল এই মুসলিম ও প্রাচ্যীয় জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার জন্য রাশিয়ার প্রয়োজন দেখা দেয় এদের জীবন, ধর্ম ও আদর্শকে জানার। এদের নিয়ে প্রাচ্যবাদী গবেষণার। তাই প্রাচ্যকে জানার, দখলের ও নিয়ন্ত্রণের জন্য রাশিয়ায় শুরু হয় প্রাচ্যবাদী গবেষণা।
প্রাচ্যকে নিয়ে রাশিয়ানদের গবেষণার নেপথ্যে
সাম্রাজ্যের দখলে থাকা প্রাচ্যীয় জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে প্রাচ্যবাদ কেন্দ্রিক গবেষণা শুরু করে রাশিয়া। প্রাচ্যের ভূখণ্ড বিশেষত মধ্য এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলো (উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কাজাখস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান) ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন আরব দেশের ভৌগোলিক ও খনিজ সম্পদে ভাগ বসানোর গোপন লিপ্সা পোষণ করত রাশিয়া। এসব দেশ ছিল পেট্রোল ও কৃষিজাত নানা প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদে ভরপুর। সে কারণেই এসব দেশের মানুষের জীবন, সংস্কৃতি ও আদর্শকে জানার প্রয়োজন হয় রাশিয়ার। যেগুলো ভালোভাবে না বুঝলে কোনো জাতির চেতনা ও প্রাণশক্তিকে কব্জা করা যায় না। সে লক্ষেই কাছ থেকে দেখার জন্য প্রাচ্যে ছুটে এসেছিলেন বহু রুশ পর্যটক। ধর্মীয়, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও সম্প্রসারণবাদী নানা লক্ষ নিয়ে তারা এসেছিলেন আরব ও ইসলামি প্রাচ্যে। এসব পর্যটকের মধ্যে ছিলেন বণিক, ধর্মগুরু ও বায়তুল মাকদিস অভিমুখে তীর্থযাত্রী। আবার এমন অনেকেও ছিলেন যারা রাশিয়ার পক্ষে লড়েছিলেন বিভিন্ন যুদ্ধে। বিভিন্ন পন্থায় তারা প্রাচ্যকে পর্যবেক্ষণ করে গিয়েছিলেন। পর্যবেক্ষণ করে এসে লিখেছিলেন ভ্রমণকাহিনি। তাদের সেই ভ্রমণবৃত্তান্ত ছিলো রুশ প্রাচ্যবিদদের গবেষণার প্রাথমিক খোরাক। কারণ, সে সব বৃত্তান্তে ওঠে এসেছিলো প্রাচ্যাীয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জাতিগত বিবরণ (Ethnographic information), তাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও জীবনধারা। সেসব ভ্রমণবৃত্তান্তের মধ্যে আছে—
- – পাদ্রী ভারসোনোভির ভ্রমণকাহিনি (ভ্রমণকাল: ১৪৬১–১৪৬২)
- – গণক ক্রেকরির ভ্রমণনামা (ভ্রমণকাল ১৩৫০ খৃ.)
- – পাদ্রী যসিমার ভ্রমণকাহিনি (ভ্রমণকাল ১৪১৯–১৪২০ খৃ.)
- – ফাদার ড্যানিয়েলের ভ্রমণকাহিনি ( ভ্রমণকাল : ১১০৬–১১০৮)
- – ভ্যাসিলির ভ্রমণবৃত্তান্ত
তবে গুরুত্বপূর্ণ যেসব মৌলিক কারণে রাশিয়ায় প্রাচ্যবাদী আন্দোলন বেগবান হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে —
- রাশিয়া ও ইস্তাম্বুলের কেন্দ্রীয় ইসলামি খেলাফতের মধ্যকার শীতল সম্পর্ক। যা বিগত তিন শতাব্দী ধরে চলমান ছিল। যে কারণে দুপক্ষের মধ্যে প্রায় তেরোটি ভয়ংকর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। আর তাই প্রতিপক্ষ উসমানি সাম্রাজ্য ও ইসলামি প্রাচ্যকে চেনার জানার জন্য প্রয়োজন হয় গবেষণার।
- রাশিয়ার আগ্রাসনে থাকা মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলো বিদ্রোহ করে বসতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। এই আতংক বিরাজ করছিল রুশ মানসিকতায়।
- প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে সাম্রাজ্য ও সম্প্রসারণবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার মানসিকতা পোষণ করত রাশিয়া। যাতে করে ভূমধ্যসাগর, গালফ ও আরব সাগরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সমুদ্র রুটে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়।
- মধ্য এশিয়ার মুসলিম ভূখণ্ডগুলোকে নিয়ন্ত্রণে ধরে রাখা, যাতে তারা স্বাধীনতার জন্য কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
- রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতির ওপর আরব ও মুসলিম প্রজাতন্ত্রলোর সমর্থন ও সম্মতি আদায় করা।
এসব দৃষ্টিকোণ সামনে রেখে রাশিয়ান প্রাচ্যবিদরা তাদের সম্পূর্ণ মনোযোগ নিবদ্ধ করেছেন আরব ও মুসলিম সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে। গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে তাদের গবেষণার প্রথম ভাগে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো। যেগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটভূমি হওয়ার পাশাপাশি একই সাথে আলকুদসের মত বিভিন্ন পবিত্র ধর্মীয় স্থাপনায় সমৃদ্ধ ছিল। মুসলিম খৃষ্টান নির্বিশেষে যেগুলো ছিল সকলের জন্য পুণ্যভূমি।
রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ
আরব ও প্রাচ্য নিয়ে রাশিয়ার প্রথম বুদ্ধিবৃত্তিক কাজটি হয়েছিল আঠারো শতকে। যখন জার সম্রাট গ্রেট পিটার্সের (Peter the Great:1672–1725) নির্দেশে বুলগেরিয়ায় সংরক্ষিত কিছু আরবি কিতাবের অনুবাদ ছাপা হয়। সেই অনূদিত রচনাগুলোকেই রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের প্রথম মৌলিক গবেষণা হিসেবে ধরা হয়। এরপর প্রসিদ্ধ লেখক এন্টিয়ক কান্তেমির (Antioch Kantemir) (১৭০৮-১৭৪৪) প্রথম আরবি হরফের ছাপাখানা তৈরি করেন। ১৭১৬ সালে রুশ ভাষায় প্রথমবারের মত কুরআনুল কারিমের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশিত হয়। সে সময়ই জার সম্রাট গ্রেট পিটার্সের নির্দেশে আরবি কিতাবের অনুবাদ, ছাপা ও গবেষণাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
এবং ১৭২২ সালে রাশিয়ার সামারা শহরে (Samara: দক্ষিণ পশ্চিম রাশিয়ার একটি শহর) প্রথম আরবি হরফের ছাপাখানা তৈরি হয়। পাঠ্যবই ছাপা হত সেখানে। ১৭৫৪ সালে মিখাইল লোমোনসভ (Mikhaylo Vasilyevich Lomonosov: 1711–1765) প্রাচ্যীয় ভাষাগুলোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাদা কুল্লিয়া ও ফ্যাকাল্টি চালু করেন। ১৭৬৩ সালে আলফ লায়লা’ (হাজার রজনী) গল্পগ্রন্থের প্রথম রাশিয়ান অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ১৮০৪ সালে, খারকভ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য ভাষা শেখানোর জন্য আলাদা ডিপার্টমেন্ট চালু হয়। এরপর ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে প্রাচ্যের বিভিন্ন ভাষা শেখানোর জন্য কাজান বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরের (যেমন আস্ত্রাখানে) মাধ্যমিক স্কুলে আরবি ভাষা শিক্ষা চালু হয়। ১৮৫২ সালের দিকে সম্রাটের নির্দেশে প্রাচ্যবিদ ও আরবি বিষয়আশয়ে পণ্ডিত বিদগ্ধদের নিয়ে একটি সংস্থা তৈরি করা হয়। ওই সংস্থায় অনেক ইহুদি সদস্যকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। সংস্থার প্রথম লক্ষ্য ছিল, ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে পবিত্র আল কুদসে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বুদ্ধিবৃত্তিক নথি তৈরি করা। এবং সেখানে রুশ প্রতিনিধিদের তত্ত্বাবধানে আশ্রয়প্রার্থী নির্বাসিত ইহুদিদের জন্য থাকার ঘর ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা। উল্লেখ্য যে, রাশিয়ার পক্ষ থেকে ফিলিস্তিনে বিদ্যমান বিভিন্ন গীর্জা, রুশ অর্থডক্সে দীক্ষিত জনগোষ্ঠী ও নানা দাতব্য সংস্থার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদল নিযুক্ত ছিল। ১৮৬৪ সালে রাশিয়ার পক্ষ থেকে সেই সংস্থার কয়েকজন সদস্যকে পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ফিলিস্তিনে পাঠিয়ে দেয়া হয় গোপনে সেখানে ইহুদিদের বসবাসের ঘর ও হাসপাতাল তৈরির জন্য। ১৮৮২ সালের মধ্যে এই সংস্থা ধীরে ধীরে একটি পরিপূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিন ও আশপাশের আরব দেশগুলোতে প্রায় একশোটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরা হয়। যেগুলোতে একসাথে মুসলিম, খৃষ্টান ও ইহুদিরা পড়াশোনা করত। এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা দশ হাজার পেরিয়ে গিয়েছিল।
১৮৮৩ সালে এই সংস্থা সম্পূর্ণ ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। এবং সেটাকে তখন মস্কো ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজ ফ্যাকাল্টি হিসেবে যুক্ত করা হয়। ধীরে ধীরে এখান থেকে আরবি ও ইসলামি শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের নানা বিষয়আশয় নিয়ে গবেষণা প্রকাশ হতে থাকে। ১৮৯১ সালে এ সংস্থা নতুন একটি প্রতিনিধি দল তৈরি করে। যাদের নাম দেয় ‘প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা পরিষদ’। এই প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকদলকে ফিলিস্তিন সহ বিভিন্ন আরব ভূখণ্ডে পাঠায় গবেষণার জন্য। সেখানে তাদের দায়িত্ব ছিল, আরবি ও ইসলামি সব ধরনের পুরাতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা। সে মতে তারা দামেস্ক, বৈরুত, হিমস, আলেপ্পো, হামা, পূর্ব ত্রিপোলি, আলকুদস, হেবরন সহ বিভিন্ন আরব শহর ভ্রমণ করে বেড়ায়। পুরাতাত্ত্বিক গবেষণায় সবচেয়ে বেশি সময় তারা অবস্থান করে আল কুদসে। সেখানে ইহুদিদের সাথে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় এমন যে কোনো পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজতে থাকে। যার উপর ভিত্তি করে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের বসতি স্থাপনের ঐতিহাসিক দলিল দাঁড় করানো যায়। সে মতে একসময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র নিয়ে তারা হাজির হয় মস্কোতে।
গবেষকদল মস্কোতে পৌঁছলে সম্রাটের নির্দেশে সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ সভা ডাকে। এবং সেই সভায় রাশিয়ার বিভিন্ন বুদ্ধিজীবি ও চিন্তাবিদদের সহায়তায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়৷ সে সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা হলেন—
- — এফ.এস. সিকোরভ F. S. Sikorov
- — জে. জে. ক্রাস্কোভস্কি J. J. Kraskovosky
- — এ. এন. বথচিয়েভ A.N. Borthchiyev
- — এস. বি. তলস্তব S. V. Tolstov
- — এফ. এফ. বিলগোভস্কায় F. F. Bilgovsky
এরাই ছিলেন রুশ প্রাচ্যবিদদের প্রথম স্বীকৃত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যক্তিবর্গ। এদের কাজ ছিল প্রথমে আরব সংশ্লিষ্ট ও দ্বিতীয়ত ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ইতিহাসকেন্দ্রিক যাবতীয় পড়াশোনা ও গবেষণা। এদের বাইরে সাধারণ রুশ একাডেমিশিয়ানদের দায়িত্ব ছিল, ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞানে ডক্টরেটধারী বিশেষজ্ঞ তৈরি করা, যাতে পরবর্তীতে তারা রাশিয়ান প্রাচ্যবাদী সংস্থায় যোগ দিতে পারে।
রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ ও ইহুদিদের জাতীয় ভূখণ্ড
১৯৭২ সালে রাশিয়ার এই প্রাচ্যবাদী সংস্থা প্রতিষ্ঠা পরবর্তী (প্রতিষ্ঠা ১৮৮২ খৃ.) নব্বই বছর পূর্তি উদযাপন করে। সে উপলক্ষে বিশাল অনুষ্ঠান হয় রাশিয়ার মস্কোতে মে মাসের ১ তারিখে। যেটা ছিল রাশিয়ার শ্রমিকদের বিশেষ দিবস। এ অনুষ্ঠানে রুশ প্রাচ্যবিদ এ. এল. তিখভস্কি সংস্থার প্রধাণের ভাষণ দেন। সেই ভাষণে বিগত নব্বই বছরে সংস্থার অর্জন ও অবদান তুলে ধরেন উপস্থিতির সামনে। সেখানে তিনি বলেন—
‘ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জাতীয় ভূখণ্ড গড়ে তুলতে রাশিয়ান প্রাচ্যবাদী সংস্থা সত্যিকার অর্থে মৌলিক ভূমিকা পালন করেছে। শুরু থেকেই সংস্থা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের প্রাচীন ঐতিহাসিক পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে রক্ষা করেছে। সেই সাথে সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, বিংশ শতাব্দীর সোভিয়েত ইউনিয়নকে দিয়ে আরব নেতাদেরকেও রাশিয়ার স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করা হয়েছে।’
তার বক্তব্য শেষ হলে বক্তৃতা দেন আরো অনেক প্রাচ্যবিদ। তাদের মধ্যে কে. বি. স্টারকোভা আলোচনা করেন মুসলিম বিশ্বের সমকালীন প্রেক্ষাপট নিয়ে। আরও আলোচনা করেন এম. এ. ক্রস্টোভসিয়েভ মিশরের প্রাচীন ফেরাউনি ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে। সবশেষে এল. ই. নারিরাদ জ্যা আলোচনা করেন ইতিহাসের আলোকে আরব ও রাশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে।⁷
মোটকথা, তাদের আলোচনায় বেরিয়ে পড়ে এমন অনেক দিক, যেগুলোকে সাধারণত রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের বৈশিষ্ট্য আলোচনায় উল্লেখ করা হয় না। প্রশ্ন হলো, রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো তাহলে কী? কোন ধরনের আলোচনা সাধারণত করা হয় সেখানে?
রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ: বৈশিষ্ট্য ও পর্যালোচনা
পশ্চিমা প্রাচ্যবাদ আর রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের মধ্যকার পার্থক্য ঠিক কোন জায়গায়? অন্য ভাবে বলতে গেলে রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের বৈশিষ্ট্য কী? অনুসন্ধিৎসু পাঠকমনে সেই প্রশ্ন ওঠে স্বাভাবিকভাবেই।
এ ব্যাপারে রাশিয়ান প্রাচ্যবিদ ও সাবেক ডিপ্লোম্যাট পেরেসিপকিন (Oleg Gerasimovich Peresypkin) (১৯৩৫–বর্তমান) এর দাবি হলো—‘দুই প্রাচ্যবাদের পার্থক্য বিস্তর। রুশ প্রাচ্যবিদ হিসেবে আমাদের গবেষণা ছিল প্রত্যেক জাতিকে তার যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। যাদের নিয়ে আমরা লেখি কিংবা গবেষণা করি, রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির বাইরে সেটা ছিল শুধুমাত্র পরস্পরকে চেনার জন্য, জানার জন্য। বিপরীতে পশ্চিমারা যেমন ফরাসীরা মধ্যপ্রাচ্য এসেছিল একটি মাত্র লক্ষ নিয়ে। আর তা হলো সাম্রাজ্যবাদ। পক্ষান্তরে রাশিয়া সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে ছিল। এ কারণেই মূলত আরবদের সাথে কখনো যুদ্ধ হয় নি আমাদের। তার মানে হলো, আমরা প্রাচ্যে এসেছিলাম প্রাচ্যকে জানার জন্য আর পশ্চিমারা এসেছিল প্রাচ্যকে দখলের জন্য।’⁸
পেরেসিপকিনের এই দাবি কতটা সত্য, তার বিচারের দাবি ইতিহাসের পাঠকের। তবে তার সাথে একই সুরে কথা বলেছেন অনেক আরব গবেষক। তাদের মতে, রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ সাম্রাজ্যবাদের লিপ্সা থেকে উদ্ভূত ছিল না। সে কারণেই রাশিয়ার সাথে কোনও যুদ্ধ করতে হয় নি আরবদের। বরং উল্টো পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীর শক্তির বিরুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়াকে তারা বন্ধুর ভূমিকায় পেয়েছে। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে তারা মিশরে মোহাম্মদ আলী পাশার শাসনামলে ইংরেজ বাহিনীর উপকূল দখলের ঘটনা উল্লেখ করেন। যা রাশিয়ার জার সরকারের সহযোগিতায় রুখে দিয়েছিল মিশরের বাহিনি। তবে ঢালাওভাবে এই দাবি করা হলে সত্যের অপলাপই করা হবে। কারণ, এই রাশিয়ান প্রাচ্যবাদই মধ্যপ্রাচ্যে আগুনের বীজ বুনে দিয়েছিল ফিলিস্তিনে ইহুদি ভূমি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। মধ্য এশিয়া আর ককেশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ডগুলোতে সাম্রাজ্যবাদ ধরে রাখার জন্য তারা ব্যবহার করেছিল প্রাচ্যবাদকে। তবে হ্যা, এটা স্বীকার করতে হবে, পশ্চিমা প্রাচ্যবাদের তুলনায় রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের অনেক ইতিবাচক দিক আছে। যেমন— রাশিয়ার সরকার বিভিন্ন যুগে আরব ও ইসলামি ঐতিহ্যের অধ্যয়নকে উৎসাহিত করেছে। বিশেষ করে এটা হয়েছিল রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন মুসলিম অঞ্চলগুলোতে। এখানকার ইসলামী জনগণের জ্ঞান প্রসারিত করার জন্য এই পদক্ষেপ নিয়েছিল রাশিয়া। সে সময় আরব সাংস্কৃতিক উৎসগুলো ইসলামি জ্ঞানচর্চার মৌলিক উপকরণে পরিণত হয়েছিল ককেশাস, মধ্য এশিয়া এমনকি রাশিয়ার জন্যও। আরব্য জ্ঞানের এই চর্চা রাশিয়ার স্বার্থে ইতিবাচকভাবে ফলিত হয়েছিল। খোদ প্রাচ্যবিদরাই স্বীকার করেছেন এই সত্য। তারা জানিয়েছেন— আমরা দীর্ঘদিন ধরে মধ্য এশিয়ার জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বসবাস করেছি। এ কারণে, অনেক আরব ও ইসলামি সংস্কৃতি ধীরে ধীরে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে৷ রুশ প্রাচ্যবিদ ব্লোনদিনের মুখ থেকেই শোনা যাক এই স্বীকারোক্তি —
‘আমরা রাশিয়ানরা এবং জারবাদী রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত এলাকার সবাই প্রাচ্যীয়। আমাদের ভূখণ্ডের এক অংশ এশিয়ায়। আমাদের সীমান্তের দুই তৃতীয়াংশ চীন এবং তুরস্ক ও অন্যান্য ইসলামি অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত। যেগুলো একসময় আরব খেলাফতের অধীনে ছিল।’⁹
অন্যদিকে রাশিয়ান প্রাচ্যবিদ ক্রাচোকোভস্কি (Ignaty Krachkovsky) (১৮৮৩–১৯৫১) উল্লেখ করেছেন—
‘১৮০৪ সালে রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের প্রথম অঙ্কুর যখন মাথা গজায়, তখনই প্রথমবারের মত রাশিয়ার উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বিভিন্ন প্রাচ্যীয় ভাষা পাঠদানের নীতি প্রবর্তিত হয়। সে সব ভাষার মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে ছিল আরবি ভাষা। অথচ সে সময় ইউরোপে সেমেটিক ভাষাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ গুরুত্বের স্থানে ছিল হিব্রু ভাষা। ফলত রাশিয়ানরা প্রাচ্যের অন্যান্য ভাষার চেয়ে অধিক গুরুত্বের সঙ্গে চর্চা করেছিল আরবি ভাষাকে।’¹⁰
রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের ভিন্ন আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, এর স্বতন্ত্র দুটি চিন্তাকেন্দ্র— থট অব স্কুল।
সেই দুই চিন্তাকেন্দ্রের একটি নিয়ন্ত্রিত হত রাশিয়ার পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতিনির্ধারকদের হাতে। এর লক্ষ ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক। বহির্বিশ্বে রাশিয়ার স্বার্থ হাসিলের জন্য এই স্কুল অব থটকে ব্যবহার করত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রাচ্যবিদ পেরেসিপকিন (১৯৩৫–বর্তমান) এই স্তরটিকে ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে—
রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ সাধারণত ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও লেবাননে অঞ্চলে সীমিত ছিল। রাশিয়ার জার সম্রাটের শাসনামলে যে অঞ্চলগুলো ছিল রোমান অর্থডক্সের লীলাভূমি। কারণ, সে যুগেই রাশান প্রাচ্যবিদরা মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে পবিত্রভূমি আল কুদস নিয়ে ব্যাপকতর গবেষণা করেছে। তার কারণ ছিল, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ধর্ম অর্থডক্সীয় খৃষ্টবাদ। ফলত রাশিয়ান প্রাচ্যবিদরা অর্থডক্স যে কোন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন ও জনগোষ্ঠীর সেবায় এগিয়ে এসেছিল, চাই তা রাশিয়ার ভেতর হোক কিংবা বাইরের যে কোথাও। এমনই প্রেক্ষাপটে ‘দি এম্পারিয়াল প্যালেস্টাইনিয়ান অর্থডক্স সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয় সম্রাটের তত্ত্বাবধানে। ধীরে ধীরে সেটা বিস্তৃত হয় সিরিয়া, লেবানন ও ফিলিস্তিনে।¹¹
রাশিয়ান প্রাচ্যবাদের মতাদর্শিক দ্বিতীয় স্কুলটি ছিল স্কুল অব পিটার্সবার্গ। বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানচর্চার পটভূমিতে এর অবস্থান ছিল সব ধরনের রাজনীতি ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। প্রথমদিকে এই স্কুলটি গড়ে ওঠেছিল পশ্চিমা বুদ্ধিজীবিতার আদলে। কিন্তু পরবর্তীতে এটি পশ্চিমা বিশ্লেষণের বাইরে স্বতন্ত্র রূপ ধারণ করে। দ্বিতীয় এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ভোলগা (বুলগেরিয়ার একটি শহর), কৃষ্ণ সাগর, ককেশিয়া অঞ্চল ও মধ্য এশিয়াসহ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলোতে কর্মরত রুশ সেনা ও সরকারি কর্মকর্তাদের চিন্তা, কর্ম ও অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে। কারণ, এসব অঞ্চলে আরব ও ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা ছিল ব্যাপক। এখানকার অনেক শহরে রীতিমতো বিশুদ্ধ আরবি ভাষা ব্যবহার হত কথ্য ভাষা হিসেবে। এর ফলে সহজেই রাশিয়ায় প্রবেশ করতে শুরু করে আরবীয় সংস্কৃতি।
এছাড়া, রাশিয়ার নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডের সন্তান ছিলেন ইমাম বুখারী, ইবনে সিনা, খারেজমি, ফারাবি ও আল বেরুনিসহ অনেক দুনিয়াবিখ্যাত মুসলিম চিন্তাবিদ ও দার্শনিক। এরা সকলেই ছিলেন মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন ভূখণ্ডের সন্তান। ফলত প্রাচ্যের এই বিশাল জ্ঞানভাণ্ডারকে উপেক্ষা করে নি রাশিয়ানরা। পশ্চিমাদের চেয়ে তুলনামূলক উদার ভাবে তারা এ জ্ঞানের চর্চা ও গবেষণা করেছে। লক্ষ যাই হোক, প্রাচ্যের বিশেষত আরব ও ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞানের যে বিপুল চর্চা তারা করেছে এবং সেগুলোর যে শৈল্পিক প্রকাশ তারা করেছে, পশ্চিমা প্রাচ্যবাদে তা ভয়ংকরভাবে অনুপস্থিত। ফলত রাশিয়ান প্রাচ্যবাদ বাদ দিলে প্রাচ্যবাদকেন্দ্রিক পড়াশোনা ও গবেষণাই অপূর্ণ থেকে যায়।
উৎস তালিকা
- সা’দুন মাহমুদ সামুক: আল ইস্তিশরাকুর রূসী: দিরাসা তারিখিয়্যা শামিলা, পৃষ্ঠা : ১৫
- সা’দুন মাহমুদ সামুক: প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা :১৬
- বিভানোভ ভেদোসেভ : তারীখুল ইত্তিহাদিস সোফিয়েতী, পৃষ্ঠা : ২৯
- সুহায়ল ফারাহ : আল ইস্তিশরাকুর রূসী : নাশআতুহু ওয়া মারাহিলুহুত তারীখিয়্যা, পৃষ্ঠা : ২২৫
- সা’দুন মাহমুদ সামুক : মুখতাসার ফী তারীখিল কানীসা, পৃষ্ঠা : ১৪৬)
- বিভানভ ভেদোসেভ : তারীখুল ইত্তিহাদিস সোভিয়েতি, পৃষ্ঠা : ১০৪,১২৩
- মুহাম্মদ আসাদ শিহাব: আল ইস্তিশরাকুর রূসী (‘মাজাল্লাতুল উম্মাহ’ ম্যাগাজিন: শাবান ১৪০২ সংখ্যা)
- লন্ডনভিত্তিক ‘ঈলাফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত পেরসিপকিনের সাক্ষাৎকার, সংখ্যা : ২০ মে ২০০৫
- ইয়াহইয়া মুরাদ : মু’জামু আসমাইল মুস্তাশরিকীন, পৃষ্ঠা :
- ইগনাতি ক্রাচোকোভস্কি : ‘তারীখুল ইস্তি’রাব আর রূসী’ এর সূত্রে ড. তারেক আহমদ শামস, কুয়েতের ‘আল আরাবি’ ম্যাগাজিন, এপ্রিল ২০২০ সংখ্যা
- লন্ডনভিত্তিক ‘ঈলাফ’ পত্রিকায় প্রকাশিত পেরসিপকিনের সাক্ষাৎকার, সংখ্যা : ২০ মে ২০০৫