এক মহাবিস্ময়ে আমাদের পথচলার শুরু। জিবরাইল এসে প্রথম শব্দই উচ্চারণ করলেন ‘পড়ুন’। আমাদের নবী অনভ্যস্ততায় কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে বললেন- ‘আমি তো পড়তে জানি না’। জিবরাইল আবার বললেন ‘পড়ুন’। প্রিয়নবী কিছু বুঝে উঠতে না পেরে একই উত্তর দিলেন। জিবরাইল (আল্লাহর প্রেরিত শব্দে) বললেন- ‘পড়ুন আপনার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’|
সমগ্র পৃথিবীর জন্য রহমত হিসেবে প্রেরীত আমাদের প্রিয়নবী এই নির্দেশকে সঙ্গ করে তমসাচ্ছন্নে ঘেরা পৃথিবীতে আলোর কিরণ প্রজ্বলিত করতে শুরু করলেন। সূচনা হল বর্ববরতার ঝঞ্ঝাটে আচ্ছাদিত মানব ফিতরাতকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত করার। পর্যায়ক্রমে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্বকে মানব-হৃদয়ে প্রোথিত করতে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে রাসুলের মুখে ঐশী শব্দে উচ্চারিত হলো ‘আপনি বলুন যারা জানে আর যারা জানে না তারা কি সমপর্যায়ের? রাসুল নিজে বললেন ‘আমার যারা উম্মত (যারা মুসলিম) তাদের সকলের উপর জ্ঞান অন্বেষণ করা বাধ্যতামূলক। এরই ধারাবাহিকতায় জ্ঞানচর্চাকে কার্যকর করার জন্য মক্কিজীবনে প্রতিষ্ঠিত হলো দারুল আরকাম। যেখানে জ্ঞান অর্জন করেছেন আলী রা. এর মত জগদ্বিখ্যাত মনীষী। আর মদিনায় গিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন আসহাবুস-সুফফা। যেখানে জ্ঞান অর্জন করে পুরো পৃথিবীকে উপকৃত করেছেন আবু হুরায়রা ও ইবনে মাসউদ রা. এর মত সাহাবীরা।
এক মহা সমারোহে জ্ঞানচর্চার স্বতস্ফূর্ত উদ্যম দেখা দিল নিরক্ষর হিসেবে পরিচিত আরব উম্মিদের মাঝে। জ্ঞান অর্জনের এই প্রচেষ্টাকে সামগ্রিক করার জন্য আল্লাহ তায়ালা পথনির্দেশ করে বলেলন- ‘প্রত্যেক গোত্রের/দলের কিছু সংখ্যক লোক যেন দ্বীনের গভীর জ্ঞান লাভ করার জন্য বের হয়ে যায়, যাতে তারা স্বজাতির নিকট ফিরে তাদেরকে সতর্ক করতে পারে” রাসুল সাঃ আরো উৎসাহপূর্ণ কণ্ঠে বলেলন- যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করার জন্য রাস্তায় বের হবে, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতের পথকে সহজ করে দিবেন। অন্যত্র বলেছেন- যে জ্ঞান অন্বেষণে ঘর থেকে বের হলো, সে ঘরে ফেরা পর্যন্ত আল্লাহর পথে আছে বলে পরিগণিত হবে। অর্থাৎ ঘরে ফেরার আগেই তার মৃত্যু হলে সে শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করবে। পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার আগে বিদায়-হজের চুড়ান্ত ভাষণে সমগ্র মুসলিম জাতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘তোমরা আমার পক্ষ থেকে একটি বার্তা হলেও পৌঁছিয়ে দাও’
ব্যস, শুরু হয়ে গেল ইট-পাথর, দূর্গম উপত্যকা ও মরুভূমি অতিক্রম করে জ্ঞান অর্জনের পথে যাত্রা। উম্মাহর আলিমরা এই যাত্রার নাম দিলেন ‘রিহলাহ ফি তালাবিল ইলম’।
রাসুল সাঃ এর যুগে রিহলাহ ফিল ইলম
আহদে নবুওতে জ্ঞান অন্বেষণের যে যাত্রা, তাকে মুআরিরখরা নাম দিয়েছেন ‘ওয়াফ্দ’। জাযিরাতুল আরবের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলবদ্ধভাবে মদিনায় রাসুল সাঃ এর নিকট যারা ইসলামের জ্ঞান অর্জন করার জন্য আসতো তাদেরকেই ওয়াফ্দ বলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশী ওয়াফদ মদিনায় এসেছে নবম হিজরীতে; ফলে এ হিজরিবর্ষের নামই হয়ে গেল ‘আমুল-ওয়াফুদ’।
সাহাবায়ে কেরামের পরবর্তী সময়ে রিহলা ফিল ইলম
রাসুল সাঃ জীবিত অবস্থায়, তিনিই ছিলেন জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। সকল জিজ্ঞাসা তার নিকট আবর্তীত হত। তিনিই সকল সমস্যার সমাধান দিতেন, এবং সকল জিজ্ঞাসার উত্তর। রাসুল সাঃ এর ইনতিকালের পর ইলম অর্জনের কেন্দ্রে পরিণত হন এমন সাহাবীরা, যারা রাসুল সাঃ থেকে সরাসরি ইলম হাসিল করেছেন। কিন্তু সাহাবীদের যারা নবীজি সাঃ থেকে ইলমের বিরাসাত লাভ করেছিলেন, তারা সকলে এক স্থানে বিদ্যমান ছিলেন না। তাদের কাউকে রাসুল সাঃ এর জীবদ্দশায় দাঈ, শিক্ষক ও শাসক হিসেবে বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। মুআয ইবনু জাবাল রা. কে রাসুল সাঃ ইয়ামানে পাঠিয়েছিলেন। রাসুল সাঃ এর ইনতিকালের পর ওমর রা. এর শাসনকালে ইবনে মাসউদ রা. কে পাঠানো হয় কুফাতে। এছাড়াও রাসুল সাঃ এর নির্দেশ ‘উপস্থিত ব্যক্তি যেন অনুপস্থিত ব্যক্তির নিকট পৌঁছে দেয়’ কে বহন করে অনেক সাহাবী ইসলামের বাণী পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন। ফলে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়া সাহাবীদের থেকে ইলম অর্জন করার জন্য সমসাময়িক সাহাবী ও তাবিঈদেরকে দূরদুরান্ত সফর করতে হয়েছে।
প্রখ্যাত তাবিঈ আতা ইবনু আবি রাবাহ বলেন- আবু আইয়ুব আনসারী রা. একবার মদিনা থেকে মিশরের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন। মিশরে পৌঁছে তিনি মাসলামা ইবনু মুখাল্লাদ আনসারীর (তৎকালীন মিশরের আমির) বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। তাঁর অনাকাঙ্খিত উপস্থিতি টের পেয়ে মাসলামা ইবনে মুখাল্লাদ কিছুটা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: কিভাবে আপনার খেদমত করতে পারি? আবু আইয়ুব আনসারী রা. বলেলন: আমি ওকবা ইবনে আমেরের সাথে দেখা করতে চাই।
মাসলামা তাঁর জন্য একজন লোক ঠিক করে দিলেন। লোকটি তাকে ওকবা ইবনে আমেরের বাড়িতে নিয়ে যাবে।
ওকবা ইবনে আমের রা. হযরত আবু আইয়ুব আনসারীকে দেখে কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলেলন- আপনি এখানে? তিনি উত্তরে বলেলন: আমি ‘মুমিন ব্যক্তির দোষ গোপন’ সম্পর্কিত হাদিসের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এসেছি। যে হাদিস জীবিতদের মাঝে আমি এবং আপনি ছাড়া আর কেউ রাসুল সাঃ এর থেকে সরাসরি শুনেনি।
ওকবা রা. বলেলন: জ্বী আমি রাসুল সাঃ কে বলতে শুনেছি- যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন মুমিন বান্দার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন।
আবু আইয়ুব আনসারী বলেলন: তুমি সত্য বলেছ। অতপর তিনি তাঁর বাহনে চড়ে মদিনার দিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন।
অনুরূপভাবে জাবের রা. একটা হাদিসের সন্ধান পেয়ে এক মাস সফর করেন মদিনা থেকে সিরিয়া পর্যন্ত। ইতিহাস এমন অসংখ্য বর্ণনার সাক্ষী যেখানে সাহাবায়ে কেরাম জ্ঞান অর্জনের স্বার্থে দুর্গম উপত্যকা, মরুভূমি পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেছেন দূর থেকে দূরতম অঞ্চলে।
সাহাবায়ে কেরামের পরবর্তী সময়ে রিহলা ফিল ইলম
প্রখ্যাত তাবিঈ সাইদ ইবনুল মুসাইয়াব রহ. বলেন- আমি একটি হাদিসের জন্য একাধারে দিনরাত সফর করতাম। আবদুল্লাহ ইবনে ফায়রুয দায়লামী বলেন- আমার কাছে ইবনে ওমর রা. থেকে একটি হাদিস পৌঁছে। আমি তা তাঁর থেকে সরাসরি শুনার জন্য ফিলিস্তিন থেকে তায়েফে চলে যাই। মুসলিম উম্মাহর জ্ঞান অণ্বেষনের এমন অসংখ্য অগণিত বর্ণনার সাক্ষ্য মেলে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। মূলত সাহাবায়ে কেরামের পরবর্তী সময়ে মুসলিম বিশ্বের ব্যপ্তি ও সমৃদ্ধির কারণে রিহলা ফিল-ইলমের প্রয়োজন ও চাহিদা বাড়তে থাকে। রাজ দরবার থেকে মরুবাসী বেদুঈন পর্যন্ত, মনিব কিংবা গোলাম, জ্ঞানার্জনের এই যাত্রায় কোন বিভেদ লক্ষ করা যায়নি। ইলমের দরজা ছিল সবার জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত। পৃথিবী জ্ঞানার্জনের এই বিশ্বায়ন আগে কখনো অবলোকন করেনি।
হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় যখন দেখা যায় বর্তমানে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সেরা ইউনিভার্সিটির তালিকায় মুসলমানদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম খুব কষ্ট করে খুঁজে বের করতে হয়। যে জাতি পুরো পৃথিবীকে জ্ঞানের তাৎপর্য বুঝিয়েছে, প্রায় এক সহস্রাব্দ যারা ছিল জ্ঞানের কেন্দ্রস্থল। যারা কার্যত দেখিয়েছে যে পৃথিবীতে নেতৃত্বশীল হয়ে থাকার জন্য জ্ঞানই হচ্ছে মূলমন্ত্র, তাদের জ্ঞানগরিমায় এমন অনাথ হয়ে পড়া জাতি হিসেবে বড় লজ্জা ও লাঞ্ছনার। আমরা কখনো কখনো এই পরাজয়কে সহনীয় করে তুলতে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনীতিতে মুসলমানদের অধোগতি ও উপনিবেশবাদের কালোথাবার অজুহাত দিয়ে থাকি, এবং সবকিছু নিয়তি বলে চালিয়ে দেই। যারা পরাজয়কে অজুহাত দিয়ে ব্যাখ্যা করে পরাজয়ের গ্লানি তাদের নিয়তিতে পরিণত হয়। জ্ঞানকে পুঁজি করে পৃথিবীর যে কোন শক্তির মোকাবেলা করা সম্ভব তা সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের পরবর্তী প্রজন্ম প্রমাণ করে গিয়েছেন। যারা মনে করে এসব অনেক পুরোনো দিনের কথা, তারা বর্তমানের দখলদার ইয়াহুদিদেরকেই দেখুক। বিশ্ব রাজনীতিতে যাদের প্রভাব প্রতিপত্তির কথা বলে বুঝানোর প্রয়োজন নাই। দেড়শ কোটি মুসলমান কেন মাত্র দুই কোটি ইয়াহুদি থেকে মুসলমানদের প্রথম কেবলা মাসজিদুল আকসা উদ্ধার করতে পারছে না। তা থেকেই অনুমান করা যায়। জ্ঞানের সামর্থ্যের সামনে সংখ্যার আধিক্য গুরুত্বহীন। এ জন্যই বলা হয়ে থাকে- পরাজিত ব্যক্তির অস্ত্র হচ্ছে অজুহাত। বা অজুহাত হচ্ছে পরাজিতের ভাষা। টেলিফোন আবিস্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল বলেন- সফল ও ব্যর্থ ব্যক্তির মাঝে একমাত্র পার্থক্য হল কাজে লেগে যাওয়া।
‘প্রজ্ঞা মুমিনের হারানো সম্পদ’- আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা অচিরেই আমাদের হারানো সম্পদ ফিরে পেতে সক্ষম হবো। আল্লাহই একমাত্র তাওফিকদাতা।