আমরা এমন একটা সময় অতিক্রম করছি, যখন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বোতামে হাত টিপে বসে আছে পৃথিবীর নিষ্ঠুর মানুষগুলো। যেকোনো মুহূর্তে আগুনের খাদ্যে পরিণত হতে পারে পৃথিবীটা। বিদ্বেষের বিষবাষ্পে আমাদের আবহাওয়া হয়ে উঠেছে বিপজ্জনক। জিঘাংসার তাণ্ডবে আমাদের জনপদগুলো হয়ে আছে অস্থির, প্রকম্পিত। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধপরায়ণতা, হানাহানি, নিষ্ঠুরতা, নির্মমতার বর্বর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে গোটা বিশ্বব্যবস্থা। দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ ঘটিয়েও মানুষের হিংসার আগুন যেন নিভল না। স্বার্থ, ক্ষমতা আর শোষণের ক্ষুধা যেন আরও রয়ে গেল ওদের। ওদের সেই রাক্ষুসে গ্রাসে একে একে ধ্বংস হয়ে গেল আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া। গণনাহীন মানুষ হলো বলির শিকার, আর আট কোটি মানুষকে বেছে নিতে হলো মানবেতর শরণার্থী জীবন। শুধু এখানেই তো ওরা থামল না! নিরীহ মানুষদের বেঁচে থাকার অধিকারও ওরা প্রত্যাখ্যান করল। ওদের চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় যুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যের বিপন্ন মানুষেরা জীবন রক্ষার আশ্রয় খুঁজতে যখন প্রাণ হাতে পাড়ি জমায় ইউরোপের উদ্দেশ্যে, তখন এই মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা নোঙর করার আগেই সাগরে ডুবিয়ে দেয় শরণার্থীদের নৌযান। যারা তীরে ভিড়ে, তারাও পায় না নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা। তারা আক্রমণের শিকার হয় মসজিদে, পথেঘাটে। মধ্যযুগীয় ক্রুসেডের চেতনা নিয়ে তাদের ওপর হামলে পড়ে সন্ত্রাসীরা। এই যখন পশ্চিমা মানবাধিকারের আসল রূপ, তখন ইসলাম সুউচ্চ কণ্ঠে ঘোষণা করছে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার। ঘোষণা করছে এই বলে : যে একজন মানুষকে বাঁচাল, সে গোটা মানবজাতিকে বাঁচাল। আর যে একজনকে হত্যা করল, সে গোটা মানবজাতিকেই হত্যা করল।
আজকের অভিশপ্ত বিশ্বব্যবস্থায় ইনসানিয়াত যখন মূক বেদনায় তড়পায়, তখন আবে হায়াতের শরবত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইসলাম। যেখানে মৃত্যুর অমানিশা, সেখানে ভোরের মিছিল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইসলাম। যেখানে পুঁজি ও প্রতিপত্তির শোষণ চোষণের অবাধ নৃত্য, সেখানে সাম্য ও সমতার তাকবীর হেঁকে ফিরে আসে ইসলাম। যেখানে সাম্রাজ্যবাদের বিষদন্ত ক্ষত-বিক্ষত করছে শান্তির পৃথিবী, সেখানে শান্তি ও সম্প্রীতির জয়নাদ নিয়ে ফিরে আসে ইসলাম।
মানুষের মৌলিক অধিকারকে ইসলাম করেছে প্রতিষ্ঠিত। মানুষের জান মাল ও ইজ্জত আব্রুর দিয়েছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। অধিকার বঞ্চিত করে মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়া কিংবা শরণার্থী বানানোর ব্যাপারে দিয়েছে কঠোর নিষেধাজ্ঞা। আল্লাহ তাআলা বলছেন: ‘যখন আমি তোমাদের অঙ্গীকার নিলাম যে তোমরা পরস্পর খুনোখুনি করবে না এবং নিজেদের দেশ থেকে বহিষ্কার করবে না, তখন তোমরা তা মেনে নিয়েছিলে এবং সাক্ষ্য দিয়েছিলে। অতপর তোমরাই পরস্পর খুনোখুনি করেছ এবং তোমাদের এক দলকে দেশে থেকে বহিষ্কার করেছ। … তাদের বহিষ্কার করাই তোমাদের জন্য অবৈধ ছিল। ’ (সুরা বাকারা : ৮৪-৮৫)।
এরপরও যারা নিগ্রহের শিকার, যারা জুলুমের হাত থেকে বাঁচতে পাড়ি জমায় এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে, তাদেরকেও নিরাপত্তার চাতালে ঠাঁই দেয় ইসলাম। সব রকমের জাতীয়তাবাদী সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে উঠে কোনো শরণার্থীকে ‘মানুষ’ হিসেবে মানবিক মূল্যবোধ বিবেচনায় আশ্রয় দেওয়ার বিধান ইসলাম নিশ্চিত করেছে। তবে আশ্রয় প্রদানের নিয়মে মুসলিম ও অমুসলিমে কিছুটা ভিন্নতা আছে। কোনো মুসলিম নিজ দেশ ছাড়া অন্য কোনো ইসলামী রাষ্ট্রে আশ্রয় চাইলে তাকে আশ্রয় প্রদান করা সে রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যক। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের কাছে ধর্মের ব্যাপারে সাহায্য চাওয়া হলে সাহায্য করা তোমাদের ওপর আবশ্যক। ’ (সুরা আনফাল : ২৭)। তাই মুসলিম শরণার্থীকে আশ্রয় প্রদান ইসলামী রাষ্ট্রের জন্য আবশ্যক। অমুসলিম শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানে ইসলামের নীতির নাম ‘আমান’। ইসলামের দৃষ্টিতে ‘আমান’ হলো মুসলিম দেশের শাসক ও নাগরিক কর্তৃক অমুসলিম দেশের কোনো অমুসলিম নাগরিককে নির্ধারিত সময়ের জন্য নিরাপত্তা প্রদান করা। ’
এর মধ্যে শরণার্থী নীতিতে ইসলাম সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে নারী ও শিশুর নিরাপত্তার ক্ষেত্রে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, কোনো মুমিনা (বিশ্বাসী) নারী হিজরত করে তোমাদের কাছে এলে তোমরা তার পরীক্ষা নাও। আল্লাহ তাদের ঈমান সম্পর্কে ভালো জানেন। তাদের ঈমানদার পেলে আর তাদেরকে কাফেরদের কাছে ফিরিয়ে দিও না। ’ (সুরা মুমতাহিনা : ১০)।
নারী ও শিশুকে আশ্রয় প্রদানের বৃহৎ প্রশ্নে প্রয়োজনে প্রচলিত চুক্তি ও অঙ্গীকার ভেঙ্গে হলেও তা করার নজির রয়েছে ইসলামে। হুদায়বিয়ার সন্ধিতে মক্কা থেকে কেউ মদিনায় এলে তাকে মক্কায় ফিরিয়ে দেওয়ার শর্ত ছিল। বেশ কয়েকজন পুরুষ সাহাবি মদিনায় এলে তাদেরকে মক্কায় ফিরিয়ে দেওয়াও হয়। কিন্তু একজন নারী যখন মদিনায় আশ্রয় নিতে চান তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আয়াত নাজিল করে তাকে আশ্রয় দিতে বলেন। (ইবনে কাসির : ৮/৯১)।
শরণার্থীদের ব্যাপারে ইসলাম উদার। তবে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানই শেষ সমাধান নয়। ঈমান, জীবন ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তার জন্য দেশত্যাগের অনুমতি দিলেও নিজের দেশকে শত্রুমুক্ত করে তাতে ফিরে যেতেই উৎসাহ দেয় ইসলাম। হজরত মুসা (আ.) আল্লাহ তাআলার নির্দেশে মাদায়েন হিজরত করলেও মাদায়েন থেকে নিজ দেশে ফিরে এসেছিলেন। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)ও ঐতিহাসিক মক্কা বিজয়ের সফল অভিযানের মাধ্যমে মক্কাকে স্বাধীনতার অধিকার হরণকারী জালেমদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে দেশত্যাগী মুহাজিরদের জন্য মক্কায় ফিরে যাবার মতো নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করেছিলেন।
তথাকথিত এই মানবাধিকার সংস্থা আর মানবতার বুলি আওড়ানো ইউরোপে শরণার্থী অধিকারেও চলে বর্ণবাদ ও বৈষম্য। লালচুলের ইউক্রেনীরা সেখানে নিরাপদ আশ্রয় পেলেও ইউরোপীয়দের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে অসহায় সিরিয়াবাসীরা সেখান থেকে বিতাড়িত। নিরাপদে জীবন নিয়ে বাঁচার জন্য যে ডিঙিনৌকায় তারা ওঠে, তীরে ভিড়ার আগেই সেগুলো ডুবিয়ে দেয় ন্যাটোর পানিসীমান্ত রক্ষীরা। অন্যদিকে জাতিসংঘের দফতরে ওঁৎ পেতে থাকে পাঁচটি ক্ষুধার্ত রাক্ষস। আন্তর্জাতিক আদালতে পেতে রাখা হয়েছে ফাঁদ। বিশ্বব্যাংকের ছায়ার নিচে দাড়াতে গেলে বড়শি দিয়ে টেনে নেওয়া হবে!
ইসলামের ইতিহাসও কানায় কানায় ভরা নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের নজির দিয়ে। ইতিহাস সাক্ষী, তা না হলে মধ্যযুগে ইউরোপের অর্থোডক্স চার্চের খ্রিস্টানদের দ্বারা নিপীড়িত অপরাপর খ্রিস্টান উপদলগুলো তৎকালীন উসমানী খেলাফতের অধীনে শান্তির আবাস খুঁজত না। উসমানী খলিফা সুলতান দ্বিতীয় মুরাদের নাম বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় স্বতন্ত্র মর্যাদায় লেখা আছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব প্রজাকুলের জন্য তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়-দয়ার্দ্র। ‘দ্য প্রিচিং অব ইসলাম’ গ্রন্থে স্যার টমাস ওয়াকার আর্নল্ড দেখিয়েছেন , কীভাবে খ্রিষ্টান সম্রাটদের অধীনে থাকা জনগোষ্ঠী মুসলিম শাসনকে স্বাগত জানাত। কীভাবে তারা ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থার উদার বুকে লাভ করত আশ্রয়। ইসলাম কীভাবে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে করেছিল ভালোবাসার চাষাবাদ। অল্প সময়ে কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল ইসলাম জগৎজুড়ে।
কিন্তু আজকের পৃথিবীতে আমরা কী দেখছি? আমরা দেখছি, যারা মানবতার শ্লোগান তুলছে, সম্পদের লোভে, আধিপত্যের লড়াইয়ে তারাই পৃথিবীটাকে বানিয়ে ছাড়ছে মৃতপুরী। কী ছিল না প্রাকৃতিক সম্পদ আর ঐশ্বর্যে ভরা মধ্যপ্রাচ্যে? সমৃদ্ধ ইরাক আর সিরিয়ায় কোন স্বার্থে তারা এসেছিল? শান্তি সুখের লিবিয়ায় কারা চাপিয়ে দিল গৃহযুদ্ধ? জটিলতা ও কুটিলতায় পৃথিবীটাকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেল কারা? আট কোটি মানুষকে কারা বানাল বাস্তুহারা, শরণার্থী? এই পরিস্থিতিতে বিপন্ন মানুষেরা কী করবে? কোথায় দাঁড়াবে? জাতিসংঘের কাছেও সুবিচারের অধিকার সংরক্ষিত। তথাকথিত এই মানবাধিকার সংস্থা আর মানবতার বুলি আওড়ানো ইউরোপে শরণার্থী অধিকারেও চলে বর্ণবাদ ও বৈষম্য। লালচুলের ইউক্রেনীরা সেখানে নিরাপদ আশ্রয় পেলেও ইউরোপীয়দের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধে অসহায় সিরিয়াবাসীরা সেখান থেকে বিতাড়িত। নিরাপদে জীবন নিয়ে বাঁচার জন্য যে ডিঙিনৌকায় তারা ওঠে, তীরে ভিড়ার আগেই সেগুলো ডুবিয়ে দেয় ন্যাটোর পানিসীমান্ত রক্ষীরা। অন্যদিকে জাতিসংঘের দফতরে ওঁৎ পেতে থাকে পাঁচটি ক্ষুধার্ত রাক্ষস। আন্তর্জাতিক আদালতে পেতে রাখা হয়েছে ফাঁদ। বিশ্বব্যাংকের ছায়ার নিচে দাড়াতে গেলে বড়শি দিয়ে টেনে নেওয়া হবে!
এই যখন পরিস্থিতি, তখন ফিরে আসতেই হবে ইসলামের কাছে। এছাড়া কোনও বিকল্প নেই। বিকল্প নেই ইউরোপ আফ্রিকা সহ সাত মহাদেশের তাবৎ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, হতাশাগ্রস্ত, শিকড়ছেড়া উদ্বিগ্ন মানুষের। জালেম মজলুমের লড়াইয়ে শোষিতের একটি মাত্রই অবলম্বন — ইসলাম ও ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা.। বঞ্চিত মানুষ যদি অধিকার পেতে চায়, তাহলে একটি মাত্রই অবলম্বন– ইসলাম ও ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা.। বিপর্যয়ের বিরামহীন তাণ্ডব থেকে পৃথিবীকে বাঁচাবার একটি মাত্র অবলম্বন– ইসলাম ও ইসলামের নবী মুহাম্মদ সা.। সেই অবলম্বনকে সম্বল করে মানবতা যখন অস্তিত্বের সংগ্রামে অভিযাত্রা শুরু করবে, তখনই পৃথিবীটা পরিণত হবে স্বর্গের উদ্যানে।
লেখক:
শিক্ষার্থী, আকীদাহ অ্যান্ড ফিলোসোফি ডিপার্টমেন্ট, আল আজহার ইউনিভার্সিটি, কায়রো, মিশর।