পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে ঘোষণা করেছেন আশরাফুল মাখলুকাত অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে। সৃষ্টির এই সেরা জীব যেন সহজ ও সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারে, তার দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্যই তৈরি হয়েছে ধর্মের। মানুষ ও কালের বিবর্তনে ধর্মেও এসেছে বহুমাত্রিক পরিবর্তন। এ কারণেই সঠিক ধর্ম নির্বাচনের ক্ষেত্রে মানুষকে আল্লাহ তাআলা আকল দিয়েছেন। দিয়েছেন ভাল মন্দের পার্থক্য করার ক্ষমতা। এবং এই পার্থক্য করতে গিয়েই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধর্ম, দল, মত ও সম্প্রদায়। আবার আবহাওয়া সময় ও কালের বিভিন্নতায় মানুষের বর্ণ, কাঠামো ও স্বভাবে এসেছে পরিবর্তন। চলমান সমাজের এমন হরহামেশা রঙবদলানোর প্রেক্ষিতে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, সবিশেষ মুসলমানদের সাথে অন্য ধর্মাবলম্বীদের সম্পর্ক কি হবে—এ সম্পর্কে ইসলাম বিশ্ববাসীকে কী বলে, তা নিয়ে আলোচনা সবদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবো, ইসলাম সূচনা থেকেই ইনসাফ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার প্রতি তৎপর। মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার ও সমাজে বসবাস করার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য, ধনী গরীব সাদা কালোর পার্থক্য উঠিয়ে দেওয়ার জন্য, অন্যায় অত্যাচার বন্ধ করার জন্য ইসলাম সরব থেকেছে তখন থেকেই। কারণ, ইসলামপূর্ব সময়টা ছিল জাহিলিয়্যাতে পূর্ণ, জুলুম অন্যায় অত্যাচার রক্তপাত বেহায়াপনা ও অশ্লীলতায় নিমজ্জিত। দাস-দাসী, গরিব বা নিম্নশ্রেনীকে মানুষ মনে করা হতো না। লুটতরাজ, ধোঁকাবাজি ,খুনখারাবী ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। যাকে ইতিহাসে “আইয়ামে জাহেলিয়াত” বা বর্বরতার যুগ হিসেবে চিনে। ইসলাম আসার পর সর্বপ্রথম মানুষকে মানুষ পরিচয়ে বেঁচে থাকার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। এমনকি অন্য মাখলুকাতের উপর শ্রেষ্ঠত্বও দিয়েছে। আল-কুরআন বলে, “হে মানবজাতি” তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একজন মানুষ থেকেই সৃষ্টি করেছেন, তার থেকেই তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন এবং দু’জন থেকে বহু সংখ্যক নারী ও পুরুষ বিস্তার ঘটিয়েছেন।”
(আল-কুরাআন ৪ : ১)
সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ইসলাম।
মানুষের মধ্যে সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে বিদায় হজের ভাষণে ঘোষণা করেছেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদিপিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনোমতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের উপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়, আবার কালোও সাদার চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে তাকওয়া। এর মাধ্যমেই আল্লাহর কাছে তোমাদের সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ।’ (বায়হাকি)
এভাবে ইসলাম জাতি, ধর্ম ও বর্ণের আভিজাত্য, ধনৈশ্বর্যের অহংকার, পদমর্যদা ও জ্ঞান গরিমার আস্ফালনকে চুরমার করে সকল মানুষকে সাম্যের শিকলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেছে।
পবিত্র কুরআন যে বারবার ‘হে মানব জাতি’ এবং ‘হে আদম সন্তানেরা’ বলে সম্বোধন করে থাকে সেটা এজন্য করে থাকে, যাতে মানুষের মনে মানবীয় ঐক্যের ধারণা সৃষ্টি ও তা বদ্ধমূল হয়ে যায়। অনুরূপভাবে ‘হে ঈমানদারগণ’ এবং ‘হে মুমিনগণ’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে যাতে তাদের ভেতরে বংশীয় বা শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টির অবকাশ না থাকে।
(মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ.১৪১)।
কেন মানুষকে বিভিন্ন গোত্রে ও জাতিতে বিভক্ত করা হয়েছে ?
এ বিষয়টি পবিত্র কুরআন খোলাশা করে বলেছে এভাবে, “হে মানবজাতি, আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি একজন পুরুষ ও একজন স্ত্রী থেকে, এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরের সাথে পরিচিত হতে পার।” (সূরা হুজুরাত ৪৯ : ১৩)
মানবপ্রেম, বিদ্বেষহীন আচরণ, সহমর্মিতা ও সম্প্রীতির আদর্শই হলো ইসলামের মূল শিক্ষা
“নিশ্চয়ই মানবজাতি একখণ্ড সমাজ” পবিত্র কুরআনের (২:২১৩) এই উদাত্ত ঘোষণার ব্যাখ্যায় বিদায় হজের ভাষণে সমাজের মানুষের প্রতি ভালবাসা, আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গির বিষয়ে মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘সমগ্র সৃষ্টি আল্লাহরই পরিবার। যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তবে মানবজাতিকে ভালোবাস। যদি সেই প্রভুর (আল্লাহর) সামনে যেতে চাও, তবে তাঁর সৃষ্টজীবকে ভালোবাস, যা তোমরা নিজের জন্য পছন্দ কর তাদের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য বর্জন কর, তাদের জন্য তাই বর্জন করবে। তুমি তাদের প্রতি সেই ব্যবহার কর, যা তুমি নিজের জন্য পছন্দ কর। তোমরা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করো না, পরস্পর হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না, তোমরা আল্লাহর দাস ও পরস্পর পরস্পরের ভাই হয়ে যাও”।
(সৈয়দ বদরুদ্দোজা, হযরত মুহাম্মদ (দ.): তাহার শিক্ষা ও অবদান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৯৭, পৃ.৪৯-৫০, উদ্ধৃতি, মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ, প্রগুক্ত, পৃ.১৪২)।
ইসলাম সমগ্র পৃথিবীবাসী, মানুষ, প্রাণী ও জীব জগতের প্রতি সার্বজনীন ভালোবাসা ও দয়ার আচরণ করতে নির্দেশ দেয়। এ বিষয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দঃ) বলেছেন, ‘যারা দয়া করে দয়াময় আল্লাহ্ তাদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা পৃথিবীবাসীদের প্রতি দয়া কর তাহলে আকাশবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি দয়া করবেন’।
(তিরমিযি ও আবু দাউদ, উদ্ধৃতি : দৈনন্দিন জীবনে ইসলাম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা ২০০০ পৃ. ৩৮)।
সর্বজনীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায় মোহাজের (মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকারী) ও আনসার (মদিনাবাসী)-এর মধ্যে ‘ভাই’ সম্বন্ধ স্থাপনের মধ্যে। মদিনার আউস ও খাজরাজ গোত্রের শতাব্দীর বিবাদ ভুলিয়ে মহানবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সাধারণ নাম দিয়েছেন আনসার (সাহায্যকারী)। বস্তুত ঐতিহাসিক মদিনা সনদ এর ভিত্তিতে মহানবি সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নেতৃত্বে মদিনায় আদর্শ রাষ্ট্র গঠন হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনা তথা মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি স্থাপনের এক নজিরবিহীন উদাহরণ।
ইসলাম অমুসলিমদের সাথে ভালো ব্যবহারের শিক্ষা দেয়
১. হজরত আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, আমার অমুসলিম মা আমার কাছে এলেন। আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জানতে চাইলাম—আমি কি তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবো? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ’।
(বুখারি)
২. একবার বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে দিয়ে এক ইয়াহুদির লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে ওই লাশের সম্মানার্থে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তখন হজরত জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! এটি তো ইয়াহুদির লাশ! তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেন, সে কি মানুষ নয়?’
(বুখারি)
ক্ষমা ও মহানুভবতার শিক্ষা দেয় ইসলাম
৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর সমাগত অপরাধীদের প্রতি মহানবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ঘোষণা, ‘তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অভিযোগ নেই। যাও তোমরা মুক্ত। ক্ষমা, মহানুভবতা ও মানবিকতার ইতিহাসে এ এক অনন্য দৃষ্টান্ত। একইভাবে সিনাই পর্বতের নিকটবর্তী সেন্ট ক্যাথেরিন মঠের সাধু ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে মহানবী সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের জীবন, ধর্ম ও সম্পত্তি রক্ষার যে সনদ প্রদান করেন, তা নিজ ধর্মের রাজাদের কাছ থেকেও তারা কখনো পাননি বলে ইতিহাসে প্রমান মেলে। (সৈয়দ আমির আলী, দি স্পিরিট অব ইসলাম [বঙ্গানুবাদ: মুহাম্মদ দরবেশ আলী খান] ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৯৩, পৃ.১২৮)।
মহানবী সা. বলতেন, “যে ব্যক্তি জিম্মির প্রতি অন্যায় ব্যবহার করবে এবং তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা তার উপর চাপিয়ে দিবে আমি পরকালে তার জন্য অভিযোগকারী হবো”। (মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ, ইসলাম প্রসঙ্গ, রেনেসার্স প্রিন্টার্স, ঢাকা ১৯৬৩, পৃ.৭২)। অন্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার রক্ষা না করার পরিণাম ভয়াবহ বর্ণনা করেছে ইসলাম।
হজরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিমকে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন।’
(মুসনাদে আহমাদ)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কারো ওপর জুলুম করতে নিষেধ করেছেন, যদিও মজলুম অমুসলিম হয়। তিনি বলেন, ‘তোমরা মজলুমের বদ-দোয়া থেকে বেঁচে থেকো, যদিও সে কাফির হয়। কারণ তার (মজলুমের) মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা থাকে না। অর্থাৎ তার বদ-দোয়াও দ্রুত কবুল হয়ে যায়।’ (মুসনাদে আহমাদ)
শুধু তা-ই নয়, কোনো অমুসলিম প্রতিবেশি অসুস্থ হলে তার সেবাযত্ন করাকেও ইসলাম নিষেধ করেনি। বরং অমুসলিম রোগীকে দেখতে যাওয়া নবিজির সুন্নাত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে অমুসলিম প্রতিবেশি রোগীদের দেখতে যেতেন এবং তাদেরকে সুন্দরভাবে ঈমানের দাওয়াত দিতেন। তাদের সেবাযত্ন করতেন। হাদিসে এসেছে—হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, এক ইয়াহুদি গোলাম রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমত করত। যখন সে অসুস্থ হলো, তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে দেখতে গেলেন, তার মাথার দিকে বসলেন আর তাকে বললেন, তুমি ইসলাম গ্রহণ করো! তখন সে তার পিতার দিকে দেখল। পিতা বললেন, তুমি আবুল কাসেমের অনুসরণ করো। ফলে সে ইসলাম গ্রহণ করল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই বলে বের হলেন—আল্লাহর শুকরিয়া যে, যিনি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়েছেন।’
(বুখারি)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সম্মান করেছেন। হোক সে মুসলিম কিংবা অমুসলিম, কাফির, ইয়াহুদি কিংবা খ্রিস্টান।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় আমাদের করণীয়
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করেন, তখন ‘মদিনা সনদ’ ঘোষণা করেন। এ সনদে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান সম্পর্কিত বিষয়গুলোও উল্লেখযোগ্য ধারা হিসেবে স্থান পেয়েছিল।
সে সময় মদিনায় মুসলমানসহ, ইহুদি এবং আওস ও খাযরায মিলে মোট ১২ টি উপগোত্রের লোকজনের বসবাস ছিল। ইসলামের প্রথম যুগের এই চরম গোষ্ঠীগত মতানৈক্য ও সংঘাতের মধ্যে ‘মদিনা সনদ’-এর আলোকে সব গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে কীভাবে শান্তিপূর্ণভাবেই না সহাবস্থান করেছিলেন। যা নতুন ইসলামি রাষ্ট্র মদিনাকে একটি অতুলনীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
ঐতিহাসিক ‘মদিনা সনদ’ এর মাধ্যমে শান্তির বার্তাবাহক বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে সবার মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাম্য-মৈত্রীর সুদৃঢ় বন্ধন রচনা করে আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের অদ্বিতীয় নজির স্থাপন করেছিলেন। তাতে উল্লেখ ছিল—
> সনদে স্বাক্ষরকারী সব গোত্র-সম্প্রদায় ‘মদিনা রাষ্ট্রে’ সমান অধিকার ভোগ করবে।
> সব ধর্ম সম্প্রদায়ের স্ব স্ব ধর্ম-কর্ম পালনের স্বাধীনতা ও অধিকার যথারীতি বহাল থাকবে।
> কেউ কারও ওপর কোনোরূপ হামলা বা আক্রমণ করবে না।
> সন্ধিভুক্ত কোনো সম্প্রদায় (হোক মুসলিম কিংবা অন্য ধর্মের) বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে ওই আক্রান্ত সম্প্রদায়কে সম্মিলিতভাবে সহযোগিতা করতে হবে এবং শত্রুদের প্রতিহত করতে হবে।
> কোনো নাগরিক যে কোনো অপরাধ করলে তা তার ব্যক্তিগত অপরাধ বলে গণ্য করা হবে।
বহু ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য ‘মদিনা সনদ’ একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মদিনা সনদ স্বাক্ষরিত হওয়ার পর তৎকালীন সমাজের গোত্রগুলোর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অন্তর্কলহের অবসানসহ নৈরাজ্যমুক্ত, মানবিক মূল্যবোধে সমৃদ্ধ একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন বিশ্বমানবতার মুক্তির দূত। ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় তিনি কারো প্রতি কোনো ধরণের পক্ষপাতমূলক আচরণ করেননি। অন্যায়ের ক্ষেত্রেও তিনি কারো সঙ্গে আপোষ করেননি। অন্যায়ভাবে কোনো মুসলিমের পক্ষ অবলম্বনও করেননি। তিনি ছিলেন ন্যায়ের প্রতীক। মানুষ হিসেবে তিনি সবার প্রতি ছিলেন উদার ও উত্তম আচরণকারী। প্রতিবেশি যে-ই হোক অর্থাৎ মুসলিম কিংবা অমুসলিম তার অধিকারের ব্যাপারে তিনি ছিলেন সজাগ দৃষ্টিসম্পন্ন। সুতরাং মুসলিম উম্মাহর উচিত, ইসলামের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ উদার নীতি ও দৃষ্টান্ত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া। ইসলাম ও মুসলমানদের লালিত এবং মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুমহান আদর্শগুলো বিশ্বব্যাপী তুলে ধরা। আর তাতে মুসলিম-অমুসলিম সব মানুষের কাছে পৌছে যাবে বিশ্বনবির সুমহান আদর্শ।
লেখক: ইসলামিক থিওলজি অনুষদ, আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিশর।