‘তারা কি ভূপৃষ্ঠে ভ্রমণ করে না, যাতে তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন হৃদয় ও শ্রুতিসম্পন্ন শ্রবণের অধিকারী হতে পারে! বস্তুত চক্ষু তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে তাদের হৃদয়।’ (সূরা হজ : ৪৬)
এভাবে কোরআনের ছত্রে ছত্রে চিন্তা মুক্তির কথা বলা হয়েছে। ভাবনা, উপলব্ধি ও ইন্দ্রিয়শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি রহস্য উদঘাটনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সৃষ্টি নিয়ে এক ঘণ্টা গবেষণা করা বছরের পর বছর ইবাদত করার চেয়ে বেশি মূল্যবান। পবিত্র কোরআনে একশ’রও বেশি আয়াতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে তারা যেন চিন্তাভাবনা করে, শোনে, মনোযোগ দেয়, তুলনা করে বা পরিমাপ করে, ভাবে, বুদ্ধি ও বিবেকের চর্চা করে, বিচার বিবেচনা করে সর্বোপরি মেধাকে যেন কাজে লাগায়। বহু আয়াতের শেষাংশে এভাবে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে : তোমরা কি চিন্তা করে দেখছ না? তোমরা কি তোমাদের জ্ঞানবুদ্ধি একটুও কাজে লাগাও না? তারা কি কোরআন সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না?
কোরআনে আল্লাহ তার বান্দাদের চিন্তাশক্তি কাজে লাগাচ্ছে না কেন সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার কথা বলছিলাম আমরা। তবে এভাবে প্রশ্ন করার পাশাপাশি বহু জায়গায় আল্লাহর এ সৃষ্টি মানুষকে বিশ্বের বিচিত্র অজানা রহস্য নিয়ে ভাবতে, গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। পাশাপাশি যারা চিন্তাশক্তি, মেধা ও মননকে কাজে লাগায় না তাদের অন্ধ, বধির এমনকি চতুষ্পদ জন্তু কিংবা তাদের চেয়েও নিকৃষ্ট বলে তিরস্কার করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা আরাফের ১৭৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে : আরেকটি অকাট্য সত্য, বহু জিন ও মানুষ এমন আছে যাদের আমি জাহান্নামের জন্যই সৃষ্টি করেছি। তাদের হৃদয় আছে; কিন্তু তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ আছে; কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না। তাদের কান আছে; কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা পশুর মতো বরং তাদের চেয়েও অধম। তারা চরম গাফিলতির মধ্যে হারিয়ে গেছে।
এমনকি যারা তাদের বিবেক-বুদ্ধি, মেধা ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে কোনো বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করে না, তাদের অকর্মণ্য, উপলব্ধিহীন, অসচেতন প্রাণী বলে তিরস্কার করেছে। কোরআনে সূরা আনফালে বলা হয়েছে : আর তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা বলে যে, আমরা শুনেছি, অথচ তারা শোনে না। নিঃসন্দেহে আল্লাহতায়ালার কাছে সব প্রাণীর তুলনায় তারাই মূক ও বধির, যারা উপলব্ধি করে না।
কোরআনের নির্দেশনা অমান্য করে যারা চিন্তামুক্ত হয়ে বসে থাকে, যারা নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সৃষ্টি ও স্রষ্টার হাকিকত উপলব্ধি করার চেষ্টা করে না কোরআন তাদের মনুষ্যত্বের মর্যাদা থেকেও বঞ্চিত করেছে। কারণ, মনুষ্যত্ব ও পশুত্বের পার্থক্য রেখা যে চিন্তাশক্তি তা না থাকলে মানবীয় মর্যাদাই তো বিলীন হয়ে যায়। এজন্য কোরআন মানুষের চিন্তাশক্তির প্রতিবন্ধক বিষয়গুলোও নিষিদ্ধ করেছে। পূর্বসূরিদের অন্ধ অনুসরণ, গোঁড়ামি, কূপমণ্ডূকতা না করে ইসলামের উদার চিন্তা-দর্শনের চর্চা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মানুষ জ্ঞান-গবেষণা, চিন্তা-ভাবনা, নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তি ছাড়া একঘেয়ে হয়ে যায়। জীবনে তাদের কোনো রকম উন্নতি কিংবা পরিবর্তন আসে না। আর এ পরিস্থিতিতে অপরাপর সৃষ্টির সঙ্গে মানুষকে আলাদা ভাবার সুযোগ থাকে না। অতএব, মানুষের সঙ্গে অন্যান্য সৃষ্টির পার্থক্য হল বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা এবং উদ্ভাবনী শক্তির মধ্যে। মানুষ নতুন নতুন সৃষ্টি করতে পারঙ্গম। আর এ উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগানোর প্রণোদনা দেয়া হয়েছে হাদিসে। এক বর্ণনায় এসেছে রাসূলে আকরাম (সা.) চেষ্টা করতেন পথ চলার ক্ষেত্রে যে রাস্তা দিয়ে একবার গেছেন বিকল্প থাকলে সেই রাস্তায় না যেতে। এর মানে হল মানুষের উচিত প্রতিদিনই নতুন নতুন পথের সন্ধান করা। একই পথ নিয়ে পড়ে না থাকা। দুটি পথ থাকলে তৃতীয় পথ কী করে তৈরি করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা। এই চিন্তাকে জাগানোর জন্যই বারবার আহ্বান করেছে কোরআন।
যারা বিবেকশাসিত চিন্তা করে, আর যারা করে না, যারা জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে ভাবতে পারার ইতিবাচক পথকে অবলম্বন করে আর যারা করে না, যারা প্রজ্ঞা ও বিবেককে ব্যবহার করে আর যারা করে না, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলছেন : ‘বল, ‘অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান?’
যারা সত্যের জন্য বিবেক-বুদ্ধি কাজে লাগায় না কোনো চিন্তা করে না, গবেষণা করে না তাদের কোরআনে মূক, বধির, অন্ধ ইত্যাদি তিরস্কৃত করা হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে : ‘আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম জীব সেই বধির ও মূক যারা কিছুই উপলব্ধি করে না।’
আরও বলা হয়েছে : ‘আর যে ব্যক্তি এখানে অন্ধ সে আখেরাতেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট।’
যারা সুষ্ঠু চিন্তা করে না, তাদের ভর্ৎসনা করে আল্লাহ বলেন, ‘আমি জাহান্নামের জন্য বহু জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর আছে, (কিন্তু) তা দিয়ে তারা উপলব্ধি করে না। তাদের চোখ আছে, (অথচ) তা দিয়ে তারা দেখে না।’ (সূরা আরাফ : ১৭৯)। অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি কোরআন নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করে না, নাকি তাদের অন্তর তালাবদ্ধ?’ (সূরা মুহাম্মদ : ২৪)। যুক্তি, বুদ্ধি ও বিবেচনাবোধের প্রতি কোরআন দিয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। দিয়েছে যথাযথ মর্যাদা।
বহু আয়াতে এর বর্ণনা আছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি তো আদম সন্তানদের সম্মানিত করেছি এবং আমি তাদের স্থল ও সমুদ্রের বাহন দিয়েছি, তাদের দিয়েছি উত্তম রিজিক। আর আমি যাদের সৃষ্টি করেছি, তাদের মধ্যে অনেকের ওপর মানুষকে মর্যাদাবান করেছি।’ (সূরা ইসরা, আয়াত ৭০)।
চিন্তা-গবেষণা মানুষের সফলতার প্রধান অবলম্বন। চিন্তাশীলতা ছাড়া পৃথিবীর কোনো জাতি সমৃদ্ধ হতে পারেনি। চিন্তার বিনিময়ে পৃথিবী আজ এতদূর অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু আজকের মুসলমান চিন্তা উদ্ভাবক কোরআন পড়া থেকে দূরে সরে গেছে! কবে তারা কোরআন গবেষণায় ফিরবে? সেই আশায় এই লেখা।