‘ইউরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির এমন কোনো দিক নেই, যাতে আরব স্পেনীয় মুসলিমদের প্রভাবের চিহ্ন নেই।’ কথাটা বলেছিলেন ঐতিহাসিক রবার্ট ব্রিফল্ট। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সভ্যতাগর্বী ইউরোপকে কী এমন দান করেছিল মুসলিম স্পেন? সে নিজেই বা সমৃদ্ধ ছিল কতটা? এ প্রশ্নের জবাবে ইতিহাস বলে, স্পেন ছিল সমগ্র পৃথিবীর জ্ঞানবিজ্ঞান ও সভ্যতা সংস্কৃতির রাজধানী। মুসলিম স্পেনের বিপুল জ্ঞান, দার্শনিক সৃষ্টিকর্ম ও শিল্পকলা থেকেই ইউরোপ লাভ করেছে দর্শনচিন্তা ও সাংস্কৃতিক বিকাশের অভিনব সব স্রোতধারা।
মুসলিম শাসনামলে স্পেন পরিণত হয়েছিল জ্ঞানবিজ্ঞান, সভ্যতা সংস্কৃতি, স্থাপত্য ও শিল্পকলায় সমকালীন পৃথিবীর রাজধানীতে। সারা পৃথিবীর জ্ঞানবিজ্ঞান এসে জমা হতো কর্ডোভা নগরীতে। দামেস্ক, বাগদাদ, কনস্টান্টিনোপল, কায়রো, কায়রোয়ান ও কুফা বসরার জ্ঞানী গুণীরা জ্ঞান অন্বেষণে চলে আসতেন কর্ডোভায়। কর্ডোভার খলিফা তাদের বিশেষ সমীহ করতেন। রাজ্যে তাদের দান করতেন উচ্চাসন। এক্ষেত্রে উমাইয়া খলিফা হাকাম বিন আবদুর রহমানের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি নিজে ছিলেন জ্ঞানের এক রাজ্য। প্রচলিত জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় পরিপূর্ণ দক্ষতা ছিল তার। সমকালীন পৃথিবীর যেখানেই জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা ছিল, সেখানেই খলিফা হাকামের নিজস্ব প্রতিনিধি নিয়োজিত থাকত। তাদের কাজ ছিল ভালো বা দুষ্প্রাপ্য কোনো গ্রন্থ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা খরিদ করে খলিফার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া। তারা গ্রন্থকারদের অনুপ্রাণিত করত, যেন তারা গ্রন্থের প্রথম কপিটি খলিফার কাছে পাঠিয়ে দেন। কোনো নতুন গ্রন্থের খোঁজ পাওয়া গেলে তা হস্তগত করতে যত বিপত্তি আসুক বা তার মূল্য যত বেশি হোক হাকামের লাইব্রেরির জন্য তা অবশ্যই সংগ্রহ করা হতো। খলিফা হাকামের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিটি শাহী প্রাসাদের চেয়ে কম বড় ছিল না। সেখানে ছিল ছয় লক্ষাধিক গ্রন্থের বিশাল সমারোহ। যে তালিকায় গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের নাম লেখা ছিল, তা ছিল ৪৪ খ-ে বিভক্ত। ওই গ্রন্থাগারে হাজার হাজার বাঁধাইকারী ও অনুবাদক সর্বদা কর্মরত থাকত। তারা গ্রিক ও ইবরানি ভাষায় লিখিত কিতাবাদি আরবিতে অনুবাদ করতেন। সেসময় বিশ্বের প্রতিটি দেশে ও প্রতিটি শহরে এ কথা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল যে, কর্ডোভার খলিফা লেখক ও গ্রন্থকারদের অত্যন্ত সম্মান করেন। এ কারণেই এমন অনেক গ্রন্থকার ছিলেন যারা বাগদাদ, বসরা প্রভৃতি এলাকায় বসবাস করতেন, কিন্তু তাদের লেখা গ্রন্থাদি খলিফা হাকামের নামে উৎসর্গ করে কর্ডোভায় পাঠিয়ে দিতেন। তখন স্পেন বিশেষ করে কর্ডোভার প্রতিটি লোকই গ্রন্থাদির প্রতি আসক্ত হয়ে উঠেছিল। ফলে প্রতিটি ঘরে ক্ষুদ্র বৃহৎ একটি গ্রন্থাগার বিদ্যমান ছিল। শুধু কর্ডোভাই নয়, বরং স্পেনের প্রতিটি শহরেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় একটি পাবলিক গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল।
যেখানে জ্ঞানবিজ্ঞানের এ বিপুল চাষাবাদ, সেখানে সভ্যতা সংস্কৃতি, শিল্পকলা, স্থাপত্য ও নগরজীবনে অভাবিতপূর্ব ফসল ফলবে না, তা কী করে হয়! হ্যাঁ, স্পেনে তাই হয়েছিল। তৎকালীন ইউরোপে কর্ডোভার নগর পরিকল্পনা ও স্থাপত্য ছিল এক বিস্ময়। প্রথম আবদুর রহমান (৯১২-৯৬১), তৃতীয় হাকাম (৯৬১-৯৭৬) এবং হাজিব আল মানসুরের হাতে নগরীটি গৌরবের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। পাঁচ অংশে বিভক্ত নগরীর প্রতিটি অংশই ছিল প্রাচীর বেষ্টিত। ছিল একুশটি শহরতলি। এক লাখ ১৩ হাজার ভবনে বসবাস করতেন পাঁচ থেকে ছয় লাখ মানুষ। তিন হাজার মসজিদ, জনসাধারণের জন্য ৩০০ স্নানাগার, কর্মচারী-কর্মকর্তাদের প্রাসাদ, বিদ্যালয়, হাসপাতাল এবং জনগণের জন্য তৈরি করা সুরম্য অট্টালিকার সংখ্যা ৬০ হাজার পেরিয়ে যায়। ৭০টি বিশাল গ্রন্থাগার, অগণিত বইয়ের দোকান, অসংখ্য বিপণিকেন্দ্র, অগণিত ফোয়ারা ও নয়নাভিরাম পুষ্পোদ্যান ইত্যাদি দ্বারা সুসজ্জিত ছিল শহরটি। ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, স্থাপত্য, সংগীত, দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা, গণিতশাস্ত্র, ইতিহাস ইত্যাদির চর্চা ও বিকাশের কেন্দ্র ছিল এ নগরী। মোটকথা কর্ডোভা ছিল সে সময়ের একটি সুপরিকল্পিত নগরী। এর একদিকে ২৪ মাইল অন্যদিকে ছয় মাইল বিস্তৃতি ছিল। ঐতিহাসিক ফিলিপ কে হিট্টির মতে, ‘সেকালে উমাইয়াদের রাজধানী কর্ডোভা ছিল ইউরোপের সর্বাধিক সংস্কৃতিসম্পন্ন শহর।’
স্থাপত্যশিল্পে কর্ডোভা সমকালীন পৃথিবীকেই শুধু ছাড়িয়ে যায়নি, বরং পতনের শত শত বছর পর আজও স্পেনের স্থাপত্য স্বতন্ত্র মহিমায় ভাস্বর। আড়াই থেকে তিন লাখ মুদ্রা ব্যয় করে স্পেনের উমাইয়া খলিফারা নির্মাণ করেন কর্ডোভা জামে মসজিদ। পূর্ব পশ্চিমে যার দৈর্ঘ্য ছিল ৫০০ ফুট। এর সুন্দর ও আকর্ষণীয় মেহরাবগুলো স্থাপিত ছিল পাথরের নির্মিত এক হাজার ৪১৭টি স্তম্ভের উপর। মিহরাবের নিকট একটি উঁচু মিম্বর ছিল হাতির দাঁত ও ৩৬ হাজার বিভিন্ন রং ও বিভিন্ন কাষ্ঠখ-ের তৈরি। সেগুলোর উপর ছিল হরেক ধরনের হীরা-জহরতের কারুকাজ। দীর্ঘ সাত বছরের পরিশ্রমে মিম্বরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তৈরি করা হয়েছিল ১০৮ ফুট উঁচু মিনার। যাতে ওঠানামার জন্য নির্মিত দুটি সিঁড়ির ছিল ১০৭টি ধাপ। মসজিদের মধ্যে ছোট-বড় ১০ হাজার ঝাড়বাতি জ্বালানো হতো। তার মধ্যে সর্ববৃহৎ তিনটি ঝাড়বাতি ছিল রুপার, বাকিগুলো পিতলের তৈরি। বড় বড় ঝাড়ের মধ্যে এক হাজার ৪৮০টি প্রদীপ জ্বালানো হতো। শুধু তিনটি রূপার ঝাড়ে ছত্রিশ সের তেল পোড়ানো হতো। ৩০০ কর্মচারী ও খাদেম শুধু এই মসজিদের তদারকিতেই নিয়োজিত ছিলেন।
শুধু এই বিখ্যাত জামে মসজিদ নয়, এর মতো আরও অনেক ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও শিল্পের সমাহার ছিলে কর্ডোভায়। আজ জাহরা প্রাসাদ, সারাগোসায় বনু হুদদের আল জাফারিয়া প্রাসাদ, সেভিলের জিরাল্ডা, আল কাসার, গ্রানাডার নাসিরিদের আল হামরা ইউরোপে মুসলিম স্থাপত্যকলার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। শত শত বছর পরে এগুলো আজও বিশ্বের বিস্ময়।
শিল্পকলায়ও পিছিয়ে ছিল না মুসলিম স্পেন। সমভূমি থেকে নিয়ে পাহাড়ের পাদদেশেও চাষাবাদ হতো। একখ- ভূমিও অনুর্বর পড়ে ছিল না কোথাও। উৎপাদিত কাঁচামাল ও দ্রব্যাদির দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদা এ চাষাবাদ ও শিল্পোন্নয়নের মূল ছিল। শিল্পে বিবিধ আনুকুল্যের ফলে একক, যৌথ ও অংশীদারিত্বের কারখানাগুলো গড়ে ওঠে। মহিলারাও শিল্পে অংশগ্রহণ করতেন। দেশের প্রধান খাদ্য গম ছিল বলে আটার কল ছিল দেশের সবখানেই। পানির সাহায্যে বৈজ্ঞানিক উপায়ে মিলগুলো পরিচালিত হতো। একমাত্র গুয়াদেল কুইভির নদী দ্বারা পরিচালিত হতো পাঁচ হাজার কারখানা।
কয়েক কোটি মানুষ ছিলো বিভিন্ন শিল্পের সঙ্গে। শুধু কর্ডোভার কারখানাগুলো প্রত্যক্ষভাবে দুই লাখ পরিবারের ভরণ-পোষণের সহায় ছিল। বয়নশিল্প এতই জনপ্রিয় ছিল যে, একটি প্রদেশে তিন হাজার গ্রামে রেশমশিল্পের জন্য গুটিপোকার চাষ হতো। রাজধানীতে ছিল ১৩ হাজার তাঁতকেন্দ্র। রেশম, সিল্ক, লিনেন ইত্যাদি বস্ত্রবয়নে উস্তাদ বয়নশিল্পীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। ১৫১ হিজরিতে শুধু আসবেলিয়ার ১৬ হাজার বস্ত্র কারখানা উন্নত মানের কাপড় তৈরি করত। এগুলোতে কাজ করত এক লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক। সেভিলের রেশম কারখানাগুলোতে কাজ করত এক লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক। আলমেরিয়ায় ছিল আট হাজার তাঁত। জায়েনের ৩০০ গ্রামের অধিবাসীরা নিয়োজিত ছিল রেশমশিল্পে। এই বাস্তবতার প্রতি লক্ষ করেই উনিশ শতকের এক খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক খেদোক্তি করেছিলেন, ‘মুসলিম স্পেনে চার কোটি লোক কারখানায় কাজ করত। আজ ইউরোপের উন্নতির যুগেও এর পরিমাণ মাত্র দুই কোটি ১০ লাখ।’
বস্তুত শিল্প ও নগরজীবনের যে উন্মেষ ইউরোপকে উপহার দিয়েছিল মুসলিম স্পেন, তারই ধারাবাহিকতায় নগরজীবন ও নাগরিকতা পাখা বিস্তার করেছে আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতায়। ফিলিপ কে হিট্টির জবানিতেই শোনা যাক সরল স্বীকারোক্তি, ‘এ সময়ে অর্থাৎ দশম শতকে উমাইয়া রাজধানী কর্ডোভা ইউরোপের সবচেয়ে সংস্কৃতিবান নগরী হিসেবে স্বীয় স্থান দখল করে নেয় এবং বিশ্বে কনস্টান্টিনোপল ও বাগদাদের সঙ্গে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক লালনকেন্দ্র হিসেবে তার স্থানও অন্যতম। এর এক লাখ ১৩ হাজার গৃহ, ২১টি উপশহর, ৭০টি লাইব্রেরি এবং অগুণতি পুস্তক বিপণি, মসজিদ ও প্রাসাদরাজির বদৌলতে তা আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল এবং পর্যটকদের অন্তরে যুগপৎ শ্রদ্ধা প্রশংসার উদ্রেক করেছিল। এ নগরী (কর্ডোভা) সীমান্তবর্তী জনপদগুলো থেকে শুরু করে শত শত মাইল দীর্ঘ আলোকসজ্জিত পাথরখচিত রাস্তার সুবিধা ভোগ করত। যেখানে ওই ঘটনার ৭০০ বছর পর (অর্থাৎ ১৭০০ সালে) লন্ডনের রাস্তায় একটি সরকারি বাতিও ছিলো না ; তখনও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় উদাসীনভাবে ধর্মহীন রীতিনীতির এলোমেলো সন্তরণ অবলোকন করছিল। পক্ষান্তরে, কর্ডোভার বিজ্ঞানীরা পুরুষ-পরম্পরাক্রমে বিলাসী হাম্মামখানায় গোসলের সুবিধা ভোগ করে আসছিল।’
লেখক: শিক্ষার্থী, আল আজহার ইনস্টিটিউট, মিশর।