নগণ্য ও অনারব এক মজনুর পক্ষ থেকে, প্রিয়তম রাসুল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট,যিনি সর্বকালের, সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। যাকে সালাম জানিয়েছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন। যার আগমন-প্রতীক্ষায় ব্যাকুল ব্যগ্ৰ ছিল গোটা মহাবিশ্ব। যিনি কোটি মানুষের হৃদয়ের স্পন্দন। যার থুতু মোবারক কোনোদিন মাটিতে পড়তে দেননি, তাঁর পাগলপারা সাহাবিরা।
যাঁর প্রেমে দিওয়ানা হয়ে নান্দনিক এই বসুন্ধরাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে মর্তলোকের লাখোকোটি মানুষ।
যার সৌন্দর্যে ম্লান হয়ে যেত পূর্ণিমার চাঁদও। যিনি হাসলে পৃথিবী হেসে উঠত । আর কাঁদলে, আসমান-জমিন শোকে পাথর হয়ে যেত। যার বিচ্ছেদে সরবে কেঁদে উঠেছে নির্জীব, নিষ্প্রাণ শুকনো কাঠের টুকরোও। যার হৃদয়বাঁশির সুরে বিমুগ্ধ হয়ে পৃথিবী ছুটেছে পঙ্গপালের মতো। অন্ধকার ছিঁড়ে আলোর দিকে। কবির ভাষায়, ‘গলেছে পাহাড়, জ্বলেছে আকাশ, জেগেছে মানুষ তোমার সাথে,
তোমার পথে যাত্রীরা কভু থামেনি চরম ব্যর্থতাতে…।’
হে প্রিয়তম রাসুলে আরাবি, (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) জানি দুনিয়াজুড়ে আপনার সমাদৃতি। নিখিল মহাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে আপনার লাখো কোটি প্রেমিক। ভক্ত ও অনুরক্ত। সারা দুনিয়াতে যত মাশুক আছে, সবার আশেকদের একসঙ্গে সমবেত করলেও, আপনার মজনুদের সেতুই হবে সুদীর্ঘ, অশেষ।
পৃথিবীর সব মাশুকদের আকাশে যত চাঁদ তারা আছে, এরচে বহুশত গুণ বেশি চাঁদ-সিতারা আপনার আকাশে। আপনার আকাশটা এতটাই সুনীল যে, সপ্তাকাশের সব নীলিমাও সেখানে ম্লান দেখায়।
এটা তো নিছকই আপনার প্রেমের আকাশ।
আর আপনার হৃদয়ের আসমানটা-যে কত বহুবর্ণিল ধরার কে না জানে তা।
কিন্তু তাই বলে, আমি কি আপনার প্রেমিকও হতে পারি না?
প্রিয়তম ‘আকিব’, সত্যিই আপনি অপূর্ব গুণ-গরিমায়। অনিন্দ্যসুন্দর আপনার চরিত্রমাধুরী।
অজস্র সালাম আপনার পদতলে। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আপনাকে ভালোবাসবে না — এসাধ্য কার আছে! আপনার দিদারে ব্যাকুল নয় কোন সে চোখ?
আপনার পরশে ধন্য হতে চায় না কোন সে জন?
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কত যে মানুষ ভালোবেসেছে আপনাকে, ইতিহাস তা লিখে শেষ করতে পারবে না।
হাজারো কবি কবিতা লিখেছে আপনাকে নিয়ে।
গানের সুরে হৃদয়ের প্রেম ঢেলেছে বহু শিল্পী।
আপনাকে নিয়ে স্বপ্নের বাসর সাজিয়েছে যুগশ্রেষ্ঠসব ধ্যানী-গুণী ও ঋষি-মনীষীরা।
সাদি, রুমি, হাফিজ, জামি, আত্তার, ইকবাল, নজরুল আর ফররুখের কাব্য তো আপনার প্রেমেই ছন্দিত, স্পন্দিত ও নন্দিত হয়েছে। আপনার স্তবে তরঙ্গ তুলতে
কত বাঁশরীর সুর যে ঝংকৃত ও অনুরণিত হয়েছে কর্ণকুহরে। আহা ! কী সুমধুর সে সুর। কবিতার ভাষায়, ‘কত না বর্ণে কত না স্বর্ণে গঠিত /কত যে ছন্দে কত সংগীতে রচিত/কত না কণ্ঠে কত যে গ্রন্থে পঠিত/তব অসংখ্য কাহিনী।
প্রিয়তম ‘মাহি’ আমার, জীবন আমার ধন্য। আপনার প্রেমিক হতে পেরে।
কিন্তু, আপনি কি আমায়, আপনার আশেক বলে কাছে টেনে নেবেন? নাকি আপনিও মেনে চলেন আপন পরের পার্থক্য। হে প্রিয়তম রাসুল, একটুখানি ঠাঁই কি হবে আমার — আপনার সেই পবিত্র হৃদয়াকাশের এক কোণে! নাকি মেঘ বলে ঝড়িয়ে দেবেন আপনিও।
ইয়া রাসূলাল্লাহ, বড়োবেশি ভালোবাসি আপনাক। ঊষর মরু আরবের রাজপুত্র বলে, অনারবি এই ফকিরকে দূরে ঠেলে দেবেন না আপনি।
এই তো সেদিন দুপুরেও আপনার কথা ভেবে খুব করে কেঁদেছি। আপনি কি শুনতে পান না আমার কান্নার আওয়াজ! নাকি আমার কান্নার আওয়াজ আপনার নাগাদ পৌঁছুবার আগেই সীমান্তের কাঁটাতার আর রাক্ষুসে পাহাড়গুলো গিলে। আমার হৃদয়ের ক্রন্দন-ধ্বনি কি কখনোই আপনার হৃদয়বীণায় বেজে ওঠে না!
প্রিয় কামলিওয়ালা আমার,
চোখে দেখতে পারিনি বলে কি, হৃদয়ের আকাশেও দেখা মিলবে না আপনার! তবে কোন সে দেওয়াল। কোন সে আড়াল। আপনার আগমনে সিক্ত হয়েছে ঊষর মরুর ধূসর ভূমি। অধিকার ফিরে পেয়েছে চিরকাল বঞ্চিত ও অবাঞ্চিত হয়ে আসা মরমি মায়েরা।
স্বাধীনতা পেয়েছে শোষিত, মজদুর, শ্রমিক ও দাসেরা।
চিরশাশ্বত-গ্রন্থ কুরআন কারিমে আপনার স্তুতিগানে নাজিল হয়েছে আয়াতের পর আয়াত !
আপনাকে অতিক্রম করে আগে বেড়ে যাবে, এমন আস্পর্ধা কার। এরিস্টোটল, প্লেটো, সক্রেটিস কিংবা গ্যাটে, আপনার তুলনায় তারা বহুশত গুণ বেঁটে। আইনস্টাইন, নিউটন, শেক্সপিয়র আর গোর্কি সবাই তো প্রদীপ জ্বেলেছে, আপনার জ্ঞানের সলতে থেকেই।
আপনাকে ছাড়া ইতিহাসের পাপড়িগুলো সফেদ-শুষ্ক কাগজ মাত্র। ইতিহাসের পথিকৃৎ আপনি। অনন্য ও আলোকজ্জ্বল ইতিহাসের। ইতিহাস লকলকিয়ে উঠে আপনার প্রেমরসে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই আপনার যাত্রা। আলোর পথের যাত্রা।
যে পথে দিশা মিলে দিগভ্রান্তের। পথ্য মেলে পরকাল-ভোলা উদভ্রান্তের। আপনিই দিকপাল সর্বজনীন সংস্কৃতি ও সভ্যতার। সুতরাং, হে দয়াল নবি, রাসুলে আরাবি, প্রেমাস্পদের অতশত প্রশংসাগীতি শোনার পরও আপনাকে না দেখে কীভাবে থাকতে পারি আমি! আচ্ছা, আপনি কি পারতেন আপনার প্রেমের ভিখারি থেকে এভাবে মাঠ মাঠ ক্রোশ দূরে থাকতে?
হে প্রিয়তম রাসূলাল্লাহ, নিদেনপক্ষে একবার হলেও দেখে যান না আপনার প্রেমে মত্ত-বিভোর পাগলটাকে।
হুদহুদের মতো খবরটা কমপক্ষে জানিয়ে যান যে, আমিও ভালোবাসি তোমায়। হে প্রিয়তম ‘মুকাফ্ফি’, শুধু আপনাকে দেখার জন্য আমি বারবার চোখ মেলে তাকাই। হৃদয়ের আকাশে বারবার দেখি। নির্লিপ্ত পলকে চেয়ে থাকি আনমনে। কিন্তু আমার এই অশুচি আখিদ্বয়-যে আপনার দর্শনের অযোগ্য!
না হয় কেন দেখতে পাই না আপনাকে। আপনাকে যদি না-ই দেখতে পাব, তবে কেন আমার চোখদুটো! কার জন্য তবে আপনার আগমন এই ধরায। কে সে জন।
প্রিয় ‘হাশির’, সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আপনাকে কতটুকু ভালোবাসি তা আমি জানি না। কিন্তু, ভালোবাসার অর্থ যদি হয়, কারো দুঃখে বিধুর হওয়া, আর সুখে ফুল্ল হওয়া, তবে আমি আপনাকেই ভালোবাসি সবচেয়ে বেশি।
পাগলের মতো মাঝেমধ্যে কী যে ভাবি! ভাবি, আপনি যদি আমার নানা হতেন, আর আমি হতাম আপনার আদরের দৌহিত্র হাসান! আহা! দুজাহানের সরদারের সালাতের সিজদায় পিঠে চড়ে বসতাম আমি। কেমন শিহরণ বইত তখন আমার হৃদয়ে। জানি না, আমার এমন ভাবনাতে কোনো পাপ হবে কি না!
আপনাকে তো বলতেই পারিনি, আমার নানা আপনার মতো এত ভালো নন। আপনার মতো করে কোনোদিন আমার কপোলে চুমু এঁকে দেননি।
আমাকে আদর করতে হবে বলে আমার পৃথিবীতে আসার আগেই তিনি লুকিয়ে পড়েছেন অন্ধকার কুহরে।
আমার ফুলকচি বোনটাও সেদিন খুব করে কেঁদেছিল আপনার বিরহে। গলা টেনে টেনে কাঁদছিল আর বলছিল আচ্ছা ভাইয়া, রাসূল যদি তোমার নানা হতো, তবে তো আমারও নানা হতো।
ভাইয়া সত্যি করে বলো তো ‘উমামার’ মতো আমাকেও কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবচেয়ে প্রিয়জন বলে মূল্যবান হারটি উপহার দিতেন না?
আমাকে কাঁধে নিয়ে কি সালাত আদায় করতেন না? ইয়া রাসূলাল্লাহ, অনারবি এই ভাইবোনের হৃদয়টা আপনার ভালোবাসায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। তবুও কি আসবেন না আপনি।
কখনো মনে হয় আমি যদি মানুষ না হয়ে ‘ওহুদ’ হতাম।
যে পাহাড়কে দেখে আপনি বলেছিলেন এই ওহুদ পাহাড় আমাদেরকে ভালবাসে। আমরাও ভালোবাসি তাকে। এটা জান্নাতের পাহাড়। আহা! তবে তো আপনার ভালোবাসার সার্টিফিকেট সে কবেই পেয়ে যেতাম। সঙ্গে জান্নাতেরও। আবার কখনও স্বপ্নে দেখি মদিনার আনসারী শিশুদের সঙ্গে ‘ত্বলাআল বাদরু আলাইনা…।’ বলে অভিবাদন জানাচ্ছি আপনাকে।
কতই না সৌভাগ্যবান সেই শিশুরা যারা গানের সুরে সুরে স্বাগত জানিয়েছিল আপনাকে।
হে প্রিয়তম, আমি অভাগা বলে অনারব কবির মতো বারবার গেয়ে উঠি, ‘আয় মরু পারের হাওয়া, নিয়ে যারে মদিনায়…।’
প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আপনার মক্কী জীবনের একেকটা দিন, আমাকে ভীষণ ভাবে কাঁদায়। যখনই পড়ি, তায়েফের নরাধমেরা আপনাকে রক্তাক্ত করে ফেলেছিল; আবু জাহেল সেজদারত অবস্থায় দুর্গন্ধময় ভুরি রেখে দিয়েছিল আপনার ওপর, তখন আর কান্না আটকে রাখতে পারি না। চিৎকার করে ডুকরে কেঁদে উঠি তখন। আহ কত বেদনাবিধুর ছিল সেদিনগুলো।
হে প্রিয়তম রাসূল, যায়েদ ইবনে হারেসার মতো আমি যদি সেদিন তোমাকে কাফেরদের পাথর-বৃষ্টি থেকে আগলে রাখতে পারতাম! ধন্য মনে করতাম আমার এই নিরর্থক জীবনটাকে। হে রাসূলে আরাবি, আমি আপনার প্রেমের ফকির। আপনার ভালোবাসার কাঙাল আমি। আপনার প্রণয় ছাড়া জীবন আমার ধূ ধূ মরুভূমি। আমার হৃদয় শুধু গেয়ে উঠে, ‘চাঁদ নিভে যাক, নিবুক জোছনা; তাতে কিবা আসে যায়/হৃদয়গগনে জেগে আছো তুমি, অম্লান মহিমায়।
দেলাওয়ার আদনান
শিক্ষার্থী: আল আযহার ইনস্টিটিউট, মিশর।