গাজায় যা হচ্ছে, একে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসিবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত জাতিগত নিধনের সাথে তুলনা করা যায়। হিটলারের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বৃহৎ শক্তিগুলোর জোট বেঁধে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণের পাশে কোন বৃহৎ শক্তি নেই–এই যা পার্থক্য। ফিলিস্তিনি জনগণের কোন মারণাস্ত্র নেই, অ্যাটমবোমা নেই। তারা চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ, দারিদ্র ও উদ্বাস্তু জীবনে নাজেহাল। অতএব ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির এই পৃথিবীতে ক্ষমতাবান জায়োনিস্টরা যদি ফিলিস্তিনিদের পাইকারিভাবে হত্যা করে, লাশের উৎসবে করতে চায়, সে অধিকার তাদের আছে। এতে বাধা দেওয়া সাম্রাজ্যবাদ-শাসিত এই পৃথিবীতে সন্ত্রাসের অপর নাম। সুতরাং অবাধ গণহত্যায় হামাস যেহেতু প্রতিবন্ধক, তাই তারা সন্ত্রাসী। ফলে এদের যেভাবেই হোক ধ্বংস না করলে মধ্যপ্রাচ্যের সমূহ ক্ষতি। অতএব মধ্যপ্রাচ্যকে বাঁচাবার জন্য চলছে অবাধ গণহত্যা।
অর্ধশতাব্দীর অধিক সময় ধরে ফিলিস্তিনিদের উপর যে অমানবিক উৎপীড়ন চলছে, গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে ইসরাইল এককথায় গাজাকে পৃথিবীর বৃহত্তম কবরস্থানে পরিণত করেছে। গায়ের জোরে ফিলিস্তিনি জনগণকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে সেখানে দখলদারি জারি করে জায়নবাদীরা আশা করেছিল যে পরিকল্পিত হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে স্বাধিকারের আকাঙ্ক্ষাকে চিরতরে ঠাণ্ডা করা যাবে। কিন্তু ফিলিস্তিনি জনগণ একটি দিনের জন্য স্বাধিকারের তামান্নাকে ত্যাগ করেনি। ত্যাগ করেনি নিরাপোষ সংগ্রাম।
সেই সংগ্রামে বিপুল রক্ত, শাহাদাত ও অপরিসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে তারা অর্জন করেছে দুনিয়ার বিবেকবান মানুষের নৈতিক সমর্থন। দুনিয়ার বিবেকবান মানুষ চায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার সেই আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতেই হামাসের সংগ্রাম। এজন্য তাদের এমন এক বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সামনাসামনি লড়তে হচ্ছে যার সম্পর্কে ন্যালসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন– ‘আফ্রিকা বর্ণবাদের কীই-বা দেখেছে, বর্ণবাদী বর্বরতা থাকলে আছে জায়োনিস্টদের মধ্যে।’ জায়োনিস্টদের বিরুদ্ধে হামাসের স্বাধীনতা-সংগ্রাম মূলত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দুনিয়ার বিবেকবান মানুষের নৈতিক কামনার প্রতিনিধিত্বের সংগ্রাম।
কিন্তু জায়োনিস্টরা তো হামাসের অস্তিত্বকে মাথা তোলা সন্ত্রাস হিসেবেই দেখে। অতএব, একে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ইসরাইল নতুনভাবে হামলা করেছে। হামাসের হামলা সেতো নিছক উপলক্ষ। একে কেন্দ্র করে তারা যা করছে, একুশ শতকে এমন গণহত্যার নজির দ্বিতীয়টি নেই। এক হামলা ওসিলা বানিয়ে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল। শুরু হল নারী-পুরুষ ও শিশুহত্যার নারকীয় উৎসব। অসহায় নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর আগুন বর্ষণ করতে লাগলো যুদ্ধবিমান। ইতোমধ্যে গাজা যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। কলকারখানা, স্থাপনা, সরকারি অবকাঠামো ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে। সেখানে খাদ্য নেই, পানীয় নেই, বিদ্যুৎ নেই। হাসপাতালগুলোতে বোমা নিক্ষিপ্ত হচ্ছে, শিশুদের স্কুলগুলোতেও দ্রিম দ্রিম করে বর্ষিত হচ্ছে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’বোমা। আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ জীবাণু বোমা নিক্ষেপের আলামত পাওয়া গেছ। নিক্ষিপ্ত হয়েছে নিষিদ্ধ ফসফরাস গ্যাসের ধ্বংসাত্মক বোমা।
ইতোমধ্যে নিহত হয়েছে প্রায় ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি। যাদের মধ্যে শিশু আছে সাড়ে চার হাজার। আর আছে নারী ও বয়স্ক বেসামরিল নাগরিক। আর যারা এখনও নিহত হয়নি, তারা ত্রাস ও বর্বরতার নিকষ অন্ধকারে পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন জাহান্নামের ভয়াবহতায় সময় যাপন করছে। সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক কোন সংস্থাও যথাস্থানে পৌঁছতে পারছে না। নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারছে না। চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলি নৃশংসতার পক্ষ নিয়েছেন। তিনি সংকটের জন্য হামাসকে দায়ী করেছেন এবং জায়নবাদী গণহত্যার পক্ষে সাফাই গেয়ে চলছেন। তার বক্তব্য হল, হামাসের হুমকির বিরুদ্ধে ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে।
এইযে হামাসকে দায়ী করে রহস্যময় ’শেষ করার আহ্বান’, সাথে কিন্তু বিবেকবান বহু ইসরায়েলি ভিন্নমত পোষণ করেন। প্রকৃত ঘটনার জন্য হামাসের পরিবর্তে তারা ইসরায়েলকে দায়ী করেন। ইসরাইলী শান্তিকর্মীদের সংগঠন ‘গুশ শালোম’ ইসরায়েলি যুদ্ধাভিযানের প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং এর আড়ালে জায়নবাদী পরিকল্পনা ও পরাশক্তির ইন্ধনের নিন্দাজ্ঞাপন করেছে। নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় তো গোটা বিশ্বব্যাপীই বইছে। কিন্তু শান্তিকামী মানুষের বাদ- প্রতিবাদে কর্ণপাত না করাটাই পরাশক্তির খাসলত।
পরাশক্তি বরং প্রস্তুত হয়ে আছে জাতিসংঘে ইসরায়েলবিরোধী নিন্দা প্রস্তাব গৃহীত হলে এর উপর ভেটো পাওয়ার প্রয়োগের জন্য। ইসরায়েল প্রশ্নে তার এই নির্লজ্জ অভিভাবকত্বের কারণে ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ জায়নবাদী রাষ্ট্রটাকে আমেরিকার ‘ঘাতক শাখা’ বলে অভিহিত করেছেন। একজন হুগো শ্যাভেজের ভূমিকা যখন এই, তখন মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত মুসলিম শেখ ও বাদশাগণ হত্যায় নিরব দর্শকের রূপে আবির্ভূত হয়েছে।
তাদের কারো কারো সম্পর্কে এমন সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে যে, ইসরায়েলি আগ্রাসনের পেছনে তাদের ইন্ধন রয়েছে। কেননা তারা তাদের স্বৈরাচারী শাসন শোষণের জন্য হামাসকে বিপদ মনে করছে; এই হিসেবে যে, হামাস যদি সময়ের ব্যবধানে গাজায় একটি সত্যিকারের গণতান্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দাঁড় করাতে পারে, তাহলে সেটা তাদের দেশের জনগণের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হয়ে যাবে। এবং এতে অনুপ্রাণিত হয়ে স্বৈরাচারী শেখতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠলে পরিণতিতে তারা গদি হারাতে পারে। অতএব ইসরায়েলের সাথে আঁতাত করে হলেও হামাসের কবর রচনা করো।
কিন্তু কবর রচনা করতে চাইলেই হামাসের কবর রচিত হয়ে যায় না। এই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি সংগঠন যে মাতৃভূমির আজাদির পক্ষে সর্বোচ্চ কুরবানি প্রদর্শনের পরীক্ষায় বারবার কৃতকার্য হয়েছে, মুক্তিকামী মানুষের প্রত্যক্ষ ভোটে যাকে দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রশাসনের গুরুভার, এমন একটি সংগঠনকে বোমা মেরে কবরস্থ করার স্বপ্ন কোনদিনই বাস্তব হবার নয়। বোমার আঘাতে হামাসের নেতৃবৃন্দের অনেকেই হয়তো শহীদি ঈদগাহে সামিল হবেন, কিন্তু দেখতে না দেখতে জনগণের ভেতর থেকে নতুন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। যারা হবে এ আগ্রাসনের চেয়ে আরও অনমনীয়, জায়নবাদের মোকাবিলায় আরও আপসহীন। অতএব,আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে সমস্যাকে কেবল গুরুতর করা যাবে, ইতিবাচক কোন ফলাফল অর্জন করা যাবে না। যদি তা অর্জন করতে হয়, তাহলে শক্তির যুক্তিকে পরিহার করে বাস্তবতাকে মেনে নিতে হবে। ফিলিস্তিনের বিদ্যমান বাস্তবতা হলো, সেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্মেই দেখেছে আগ্রাসনের আগুন আর কান পেতেই প্রথম শুনেছে স্বাধীনতার স্লোগান। ফলে গোটা ফিলিস্তিনই স্বাধিকার চেতনার এক অগ্নেওগিরি হয়ে আছে। ওখানে বোমা ফেলে কাজ হবে না। পরিণতিতে কেবল প্রতিশোধপরায়ণ করা যাবে অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে। আবার জায়নবাদীরা যদি জাতিগত নিধনের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের শেষ করতে চায়, সেটা হবে আরও মহা ভুল। কেননা ইসরায়েলের ইহুদিদের চেয়ে ফিলিস্তিনিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। কতজনকে হত্যা করবে তারা? কয়েক কোটি সদস্যের একটি জাতি। যাদের উপর অর্ধশতাব্দী হত্যার কসরত চালানো হলো, ফল কী দাঁড়িয়েছে? ফিলিস্তিনিরা এখন অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। যদিও ইসরায়েলের মোকাবেলায় রকেট কোন অস্ত্রই নয়, কিন্তু এ নিয়েই তারা লড়ছে। তারা লড়ছে হালকা যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে। এর দ্বারা একসময় তারা টিকতে পারবে না, তখন তারা মানব অস্ত্র ব্যবহার করবে। যা হবে সত্যি সত্যিই। ইসরাইলের জন্য ভয়ংকর এক জবাব। নিকট অতীতে লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে লড়াইয়ে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ সত্ত্বেও ইসরায়েল পরাজয় উপহার পেয়েছিল। গাজার যুদ্ধে একপর্যায়ে হিজবুল্লাহও পুরোপুরি জড়িয়ে পড়বে। তখন যুদ্ধক্ষেত্র ফিলিস্তিন, লেবানন ছাড়িয়ে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। যে উন্মাদনা নিয়ে জায়নবাদীরা গাঁজায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে উন্মাদনা থাকলে তারা হামলা করে বসতে পারে আসল টার্গেট ইরানের ওপর, যদি তাই হয় তাহলে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে দোজখের দরজা খুলে যাবে। জয়নবাদীরা হয়তো অস্ত্র ও প্রতিপত্তির জোরে এ পরিস্থিতিকে নিজেদের জন্য বিপদজনক মনে করছে না, কিন্তু তারা যদি গাজার যুদ্ধকে আরো বিস্তৃত করে, তাহলে অচিরেই আগ্রাসন ও হত্যাকারীর বিষাক্ত প্রতিফল তুফানের মতো আর গায়ে হামলে পড়তে দেখবে।
ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধুকেছে, আফগানিস্তানে অনিঃশেষ অন্ধকার ব্যর্থতা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এর পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ইসরায়েল বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে পা বাড়ায়, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইহুদীবাদী রাষ্ট্রটির জন্য গোটা পরিস্থিতি বেসামাল রূপ ধারণ করবে। যা নিয়ন্ত্রণের সাধ্য তাদের নেই।