আল আযহার শরীফ। ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসারে মহা এক স্তম্ভ। কেউ একে বলেন ‘ইসলামের দুর্গ’। আর কেউ বলেন ‘আলোর মিনার’৷ মিশর ও গোটা বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় এটি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধ্যপন্থী ইসলামের শিক্ষা প্রচারে অসামান্য ভূমিকা রাখার কারণে গোটা দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইসলামি বিদ্যাপীঠ হিসেবে বরিত এই আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়।
আল আযহারের গোড়ার কথা:
মিসরে ফাতেমি শাসনামলের প্রথম খলিফা আল মুইজ লি-দীনিল্লাহ ৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে কায়রোতে আল-আযহার মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করেন। শিয়া মতবাদ প্রচারের জন্য মিশরে নির্মিত প্রথম মসজিদ ছিলো এটি। এর নির্মাণ শুরু করেছিলেন জাওহার আল সিকিল্লি। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে৷ এই মসজিদের সাথে ফাতেমি শাসকদের ছিলো বিশেষ ঘনিষ্ঠতা৷ নবীকন্যা সাইয়েদা ফাতেমাতুয যাহরা রা. এর নামের সাথে মিলিয়ে এই মসজিদকে তারা ‘আল-আযহার মসজিদ’ নামে অভিহিত করেছিলেন৷
ফাতেমীয় শাসকরা ধীরে ধীরে আল-আযহার মসজিদের আকৃতি প্রশস্ত করতে থাকেন৷ নির্মাণের ২৪ বছর পর ৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তারা আল আযহার মসজিদের সাথে জ্ঞানচর্চার জন্য একটি ইনস্টিটিউট গড়ে তোলেন। দরিদ্রদের জন্য নির্মাণ করেন একটি আশ্রয়স্থলও৷ এরপর সময়ের সাথে সাথে ফাতেমি খলিফারা আল আযহার মসজিদের অবকাঠামোকে আরো সম্প্রসারিত করে এর সাথে নতুন কয়েকটি মাদরাসা, শিক্ষা ভবন, মিহরাব এবং অন্যান্য স্থাপনা সংযুক্ত করেন। ফাতেমিদের পর সুলতান সালাহউদ্দীন আইয়ুবির শাসনামলে আল আযহার শরীফ অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত ছিল বিভিন্ন কারণে৷ মসজিদে খুতবা ও ব্যাপকভাবে শিক্ষা প্রদান নিষিদ্ধ ছিল। সেসময় আল আযহারে বাড়াবাড়িমূলক শিয়া মতবাদের চর্চা হতো। এর উৎপাটনের লক্ষ্যেই মূলত আল আযহারের জন্য বরাদ্দকৃত ওয়াকফ বাতিল করা হয়েছিলো৷ আযহারের উপর এই নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে এবং তা ১২৬৭ খ্রিষ্টাব্দে মামলুক শাসনের শুরু পর্যন্ত অব্যাহত থাকে৷ এরপর মামলুক শাসক জাহির বাইবার্স আযহার মসজিদে নতুন করে খুতবা চালু করেন। আল আযহারের প্রত্যাহারকৃত সকল ওয়াকফ সম্পত্তি তিনি ফিরিয়ে আনেন। ফলে নতুন করে উজ্জীবিত ও প্রাণবন্ত হতে শুরু করে আল আযহার মসজিদ। সুলতান জাহির বাইবার্স আযহার মসজিদে শিক্ষা প্রদানকেও উৎসাহিত করেন৷ মসজিদকে আবর্তন করে গড়ে ওঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ছাত্র শিক্ষকে ভরে ওঠতে থাকে ধীরে ধীরে। বলা হয় হয়, তখন থেকেই ইসলামি জ্ঞান বিজ্ঞানের জগতে আল আযহার শরীফ একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র জ্বলে ওঠতে শুরু করে৷ তৎকালীন মুসলিম জাহানে আল আযহারের ব্যাপক পরিচিতি ও সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ার পিছনে অন্যতম কারণ ছিলো, জ্ঞানের রাজধানী বাগদাদ ও প্রাচ্যের অঞ্চলগুলোতে মঙ্গোল কর্তৃক ইসলামি প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস এবং পাশ্চাত্যে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভঙ্গুর অবস্থা। এসবই মিশরে আল-আযহার শরীফের উত্থানে ব্যাপকভাবে সহায়ক করেছিলো৷
আল-আযহারের অবকাঠমো:
১৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে কায়রোতে আঘাত হানা ভূমিকম্পে আল-আযহার মসজিদের ভবন বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে মসজিদটির সংস্কার করা হয়৷ এই সংস্কারের সময় মসজিদের পাশে দুটি মাদরাসা স্থাপন করা হয় যা পরবর্তীতে আলআযহারের অধীনে যুক্ত করা হয়। ১৩৬০ খ্রিষ্টাব্দে আল আযহার মসজিদের অবকাঠামোর কাজ আরো সম্প্রসারণ করা হয়। তখন এতে আরো কিছু অতিরিক্ত কার্যক্রম যুক্ত করাহয়। ইতিপূর্বে আল আযহার শরীফের মিনার ৩ বার পড়ে গিয়েছিলো। প্রথমবার ১৩৯৭ সালে, দ্বিতীয়বার ১৪১৪ সালে এবং তৃতীয়বার ১৪২৩ সালে। যতবারই মিনার পড়েছিল শাসকদের আদেশে এবং খুব সম্ভবত শাসকদের ব্যক্তিগত অর্থায়নে তা পুনর্নির্মিত করা হয়৷ ১৫১৬ সালে কানসুহ আল-ঘুরি শাসক দুটি টাওয়ার বিশিষ্ট আযহার মসজিদে একটি মিনার স্থাপন করেন৷
আল আযহারে শিক্ষা শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না৷ এর সাথে জ্যোতির্বিদ্যা এবং গণিতের মতো অনেক সাধারণ বিজ্ঞানও অন্তর্ভুক্ত ছিল। উসমানি শাসনামলে আল আযহারের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে মুসলিম ভূখণ্ডগুলোর আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পায়। উসমানি আমলেই আযহারের শিক্ষা কারিকুলাম আগের সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ উন্নয়ন ও গতি লাভ করে।
শায়খুল আযহার পদ:
অতীতে শাসক বা প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি শায়খুল আযহার নির্ধারণ করতেন কিন্তু এখন শায়খুল আযহার ‘হাইয়াতু কিবারিল উলামা’ এর মাধ্যমে নির্বাচিত হন৷ যুগে যুগে বিখ্যাত আলেম এবং ফকীহ ব্যক্তিরা শায়খুল আযহারের পদের দায়িত্ব পালন করেছেন৷ যাদের মধ্যে রয়েছেন শায়খ মাহমুদ শালতুত, শায়খ জাদুল হক্ক আলী জাদুল হক্ক, ডক্টর মুহাম্মদ সাইয়েদ তানতাভি৷ বর্তমানে ডক্টর আহমেদ আত-তাইয়েব শায়খুল আযহারের পদ অলংকৃত করে আছেন৷
আল আযহারের প্রতিষ্ঠানসমূহ:
আল আযহার শরীফের অধীনে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো সরাসরি আল-আযহারের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়৷ সেগুলো হলো:
১. আল-আযহার সুপ্রিম কাউন্সিল/ ‘আল মাজলিসুল আ’লা লিল আযহার’:
আল-আযহারের সুপ্রিম কাউন্সিলের নেতৃত্ব দেন শাইখুল আযহার এবং এর সদস্যপদে রয়েছেন ওয়াকিলুল আযহার (আল-আযহারের আন্ডার সেক্রেটারি) আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রেসিডেন্ট, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য, আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শাখার সিনিয়র ডীনগণ, মাজমাউল বুহুসিল ইসলামি (ইসলামিক রিসার্চ একাডেমি) এর সেক্রেটারি-জেনারেলগণ এবং অন্যারা৷ ‘আল-আযহার সুপ্রিম কাউন্সিল’ আল আযহারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাধারণ নীতি প্রণয়ন এবং আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং আল-আযহার ইনস্টিটিউটগুলোর শিক্ষানীতি প্রণয়নের ক্ষমতা সংরক্ষণ করে৷ আল-আযহার ও এর অধীনস্থ সমস্ত সংস্থার বাজেট পাশ করা, তহবিল সংরক্ষণ করা, বিনিয়োগ ও পরিচালনা করা এবং আল আযহার সম্পর্কিত প্রস্তাবিত সকল আইন পর্যালোচনা ও পাশ করার দায়িত্ব পালন করে এই কমিটি৷
২. আল-আযহার সিনিয়র স্কলার্স কাউন্সিল / হাইয়াতু কিবারি উলামাইল আযহার:
‘আল-আযহার সিনিয়র স্কলার্স কাউন্সিল’ মিশরের মুসলিম জনসাধারণের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ। এই কাউন্সিলটি ১৯৬১ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জামাল আবদুন নাসেরের আমলে বিলুপ্ত করা হয়েছিল, তবে ২০১২ সালে সশস্ত্র বাহিনীর সুপ্রিম কাউন্সিলের যুগে এটি আবার পুনরুজ্জীবিত করা হয়৷ চার মাযহাবের সিনিয়র আলেমগণ দ্বারা গঠিত প্রায় ৪০ জন সদস্য রয়েছেন ‘হাইয়াতু কিবারি উলামাইল আযহার’ নামক এই পরিষদে। যার নেতৃত্ব দেন শায়খুল আযহার৷ এই পরিষদ শায়খুল আযহার নির্বাচন, মিশরের গ্র্যান্ড মুফতি মনোনীত করা এবং ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয় এবং ইসলামী আইন প্রচারের দায়িত্ব পালন করে থাকে৷
৩. ইসলামিক রিসার্চ একাডেমি/ ‘মাজমাউল বুহুসিল ইসলামি’:
‘ইসলামিক রিসার্চ একাডেমি’ ইসলাম ধর্মের সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয় গবেষণা করা, ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্থানে কাজ করা, ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি দূরীকরণ এবং বিশ্বব্যাপী এসব বিষয়ে জ্ঞানের পরিধি প্রসারিত করার দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে থাকে৷ ধর্মীয় ও আকিদা সংক্রান্ত সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও এই একাডেমি ব্যাপক ভূমিকা পালন করে থাকে৷ দেশ বিদেশে ধর্ম ও ইসলামি ঐতিহ্যের উপর প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণাগুলো পর্যালোচনা করাও এই একাডেমির একটি প্রধান দায়িত্ব৷ এছাড়াও ইসলামি শিক্ষায় উৎসাহিত করার জন্য অনেক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে ‘ইসলামিক রিসার্চ একাডেমি’৷ এই সংস্থাটি কয়েকটি বোর্ড ও কমিটির সমন্বয়ে গঠিত, যার প্রত্যেকটি ইসলামের একেকটি দিক গবেষণার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। শায়খুল আযহার হলেন ইসলামিক রিসার্চ একাডেমির প্রধান এবং তিনিই এর সমস্ত সভা পরিচালনা করে থাকেন।
প্রতি হিজরি মাসের শুরুতে এই একাডেমি ‘আল-আযহার ম্যাগাজিন’ প্রকাশ করে থাকে৷ এই ম্যাগাজিনটি সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে আল-আযহারের মুখপত্র হিসাবে পরিচিত৷ এই ম্যাগাজিনে সমসাময়িক সকল ইসলামি ইস্যুগুলো নিয়ে আযহারের পর্যালোচনাগুলো স্থান পায়৷ ফতোয়া প্রদান করা ইসলামিক রিসার্চ একাডেমির কাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ৷ ইসলামিক রিসার্চ একাডেমি কমপ্লেক্সের মধ্যে ফতোয়া প্রদানের জন্য একটি বিশেষ একটি বিভাগও রয়েছে৷
এই একাডেমিকে মিশরের অভ্যন্তরে এবং মিসরের বাইরের মুসলমানদের কাছ থেকে ধর্মীয় বিভিন্ন প্রশ্নাবলী গ্রহণ করা ও ইসলামি শরিয়াহর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সেগুলোর উত্তর প্রদান করার দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে৷ নওমুসলিমদের নাম ঘোষণা করাও এই একাডেমির দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত৷ ‘দারুল কুতুব আল আযহারীয়াহ’ বা আল-আযহার গ্রন্থাগার ইসলামিক রিসার্চ একাডেমির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এ গ্রান্থাগারে বিভিন্ন বিষয়ে রচিত প্রায় ১ লক্ষ ১৬ হাজার গ্রন্থ রয়েছে।
৪.আল-আযহার ইনস্টিটিউট সেক্টর/ ‘কিতায়ু মাআহিদিল আযহার’:
আল-আযহার ইনস্টিটিউটস সেক্টর প্রাথমিক শিক্ষার সকল স্তরে (ইবতেদায়ী – ই‘দাদী – সানুভী) দেশের সকল জেলার শাখাগুলোতে প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাসংক্রান্ত সকল বিষয় তত্ত্বাবধান করে।
৫. ইসলামিক মিশন সিটি/ ‘মাদিনাতুল বুউসিল ইসলামিয়া’:
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে মাদিনাতুল বুউসিল ইসলামিয়ার ভিত্তি স্থাপন করা হয় এবং ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জামাল আব্দুন নাসেরের যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আল আযহারে শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে আগত শিক্ষার্থী আবাসস্থল হিসাবে সেটা উদ্বোধন করা হয়৷ ৪৩ টি ভবন নিয়ে গঠিত এই মাদিনাতুল বুউস দুটি অংশে বিভক্ত৷ প্রথমটিতে ৩৫টি ভবন রয়েছে এবং একে ‘আল মাদিনাতুল কুবরা’ বলা হয়। দ্বিতীয় অংশে ৮ টি ভবন রয়েছে এবং এ অংশকে বলা হয় ‘আল-মাদিনাতুস সুগরা’।
‘মাদিনাতুল বুউসিল ইসলামিয়া’র লক্ষ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিম উম্মাহর সন্তানদের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ে তোলা এবং তাদের মধ্যকার বন্ধনকে শক্তিশালী করা। বিভিন্ন দেশের মুসলমানদের পারস্পরিক দূরত্ব ঘুচানো, জাতিগত বৈষম্য প্রতিরোধ করা এবং আল-আযহারের বিদেশী শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞানে সজ্জিত করা। যেন তারা ইসলামের দায়ী হিসাবে নিজেদের দেশে ফিরে যেতে পারে।
৬. আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়/ জামেয়াতুল আযহার:
আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় হলো আল-আযহারের অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি৷ আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক তত্ত্বাবধান এবং এর সাধারণ নীতিমালা প্রণয়ন করে থাকে আল-আযহারের সুপ্রিম কাউন্সিল৷ ১৮৭২ সালে খেদিভ ইসমাইলের শাসনামলে সর্বপ্রথম আযহারের শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ডিগ্রী প্রাপ্তির আইন জারি করা হয়৷ সেসময় আল-আযহারে শিক্ষার্থীরা যে বিষয়গুলো অধ্যয়ন করবে তা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। তখন সেটি ছিল ১১টি৷ পরবর্তীতে ১৯৩০ সালে ৪৯ নং আইন জারি করা হয়েছিল। এ আইনের অধীনে আল-আযহারের শিক্ষা ব্যবস্থা বিন্যস্ত করা হয়। আইনে উল্লেখ করা হয় যে, আল-আযহারের উচ্চ শিক্ষায় শরিয়া অনুষদ, ধর্মতত্ত্ব অনুষদ এবং আরবি ভাষা অনুষদ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬২টি অনুষদ রয়েছে৷ অনুষদগুলোকে দুটি ভিন্ন এরিয়ায় ছড়িয়ে রাখা হয়েছে৷ একটি আল-আযহার মসজিদের পাশে (দাররাসা এলাকায়) অবস্থিত, অপরটি নাসর সিটি (আল হাইউস সাদেস এলাকায়) অবস্থিত৷ এছাড়াও মিসরের বিভিন্ন জেলায় আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা রয়েছে৷
১৯৬১ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জামাল আব্দুন নাসেরের আমলে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়কে ১০৩ নং আইন অনুসারে একটি স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়৷ এই আইন অনুসারে শরিয়া, ধর্মতত্ত্ব এবং আরবি ভাষা; ইসলামিক দাওয়াহ, ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের পাশাপাশি আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিসিন, ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মেসি, কৃষি, বাণিজ্য, ভাষা, অনুবাদ, বিজ্ঞান, তারবিয়া এবং দন্তচিকিৎসা অনুষদ যুক্ত করা হয়৷ ২০১২ সালের নভেম্বরে জারি করা সেন্ট্রাল এজেন্সি ফর পাবলিক মোবিলাইজেশনের রিপোর্ট অনুসারে মিসরের সকল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষার্থীদের সংখ্যার দিক থেকে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান সবার উপরে রয়েছে৷ যা মিশরের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যার ১৬.৫ শতাংশ হয়৷ এবং ২০১২-২০১৩ শিক্ষাবর্ষে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ২লক্ষ ৬৯ হাজারে পৌঁছেছে।
আল-আযহার ও জাতীয় আন্দোলন:
প্রতিষ্ঠার পর থেকে আল-আযহার শরীফ মিশরের বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনে প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে৷ বিশ্বব্যাপী প্রকৃত মধ্যপন্থী ইসলাম ধর্ম প্রচারের ভূমিকা পালন করা ছাড়াও এটি সর্বদা মিসরের জাতীয় আন্দোলনে সব সময় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে৷ মামলুক শাসক কর্তৃক মিসরীদের উপর জুলুম অত্যাচার করার কারণে ১৭৯৫ সালে মামলুক শাসকদের বিরুদ্ধে বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয় আল-আযহার৷ ১৮০৫ সালে আল-আযহারের উলামায়ে কেরাম মিশরীয় বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং মিশরের গভর্নর হিসাবে মোহাম্মদ আলী পাশাকে তাদের শাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করেছিলেন। মিশরে ইংরেজ দখলের বিরুদ্ধে ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লবে আল-আযহারের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকগণ প্রধান ভূমিকা রেখেছিলো৷ এবং তারা ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের বিপ্লব পর্যন্ত ইংরেজ দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। মিসরের জাতীয় ইস্যুতে আল-আযহারের ভূমিকা জুলাই এর বিপ্লবের পরেই শেষ হয়নি, বরং আল-আযহার সব সময়েই মিশরের জাতীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে৷ ১৯৫৬ সালে ত্রিপক্ষীয় আগ্রাসন প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল আল-আযহার৷
২৫ জানুয়ারী বিপ্লবের পর আল-আযহার শরীফ মিশরী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলো। এছাড়াও যুগে যুগে সমাজ সংস্কারের বিভিন্ন প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব প্রদান করেছে আল-আযহার৷ এবং সব সময় মিশরের নাগরিকত্ব এবং জাতীয় ঐক্যের নীতির উপর জোর দিয়ে আসছে৷ আল আযহার জানুয়ারীর বিপ্লবের পরে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক বিবাদ দূর করতে ‘ফ্যামিলি হাউস’ পরিকল্পনা গঠন করে৷