আল আযহার আল শারিফ। একটি নাম নয় শুধু; একটি চেতনাও বটে। আধুনিক বিশ্বে ইসলামের সুমহান শান্তিবাণী ছড়িয়ে দিতে তার কোনো জুড়ি নেই। বিজাতীয় আগ্রাসন মোকাবেলায় আল আযহারের কৌশলী ভূমিকা অতুলনীয়। এই বিদ্যালয় ইসলামের শিক্ষা-সংস্কৃতি পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ সর্বত্র পৌঁছে দিচ্ছে নিষ্ঠার সাথে। আল আযহার শুধু পাঠদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে নি কখনো; বরং ইসলামের সুমহান বাণী বিশ্বদরবারে উচ্চকিত করতে তার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমরা এই লেখায় তার কিঞ্চিৎ চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস পাবো ইনশাআল্লাহ।
এই ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় বিদ্যাপীঠ ত্রিশের দশকে একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়। ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানকে আরও সহজভাবে মানবসমাজে বিলিয়ে দিতে নতুনভাবে শ্রেণিবিন্যাস ও পাঠবিন্যাস সাজানো হয়; যা এই প্রাচীন বিদ্যালয়টিকে আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করে তোলে। আর ষাটের দশকে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিদ্যার মতো বিষয়গুলো পুনরায় পাঠদান শুরু করা হয় আল-আযহারে। এতে করে মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় সকল শিক্ষা এখান থেকে অর্জন করার সুযোগ তৈরি হয়। সাধারণ বিষয়াদির সাথে ধর্মীয় শিক্ষার মৌলিক বিষয়গুলো একজন শিক্ষার্থীর জন্য শেখা সহজ ও বোধগম্য হয়ে যায়।
ইসলামিক রিসার্চ একাডেমী ও অধীনস্থ বিভাগগুলো
ইসলামের জ্ঞান-বিজ্ঞান বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে সময়ে সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে আল আযহার। গঠন করে ইসলামিক রিসার্চ একাডেমী (মাজমাউল বুহুসিল ইসলামিয়া) নামে একটি সংস্থা। এই সংস্থার কাজ হলো, মিশরসহ পুরো বিশ্বে দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনা, বিশুদ্ধ ইসলামি শিক্ষার প্রসার ঘটানো, মুসলমানদের নানারকম সমস্যা সমাধান করা এবং ইসলামের ওপর উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে গবেষণা ও তা নিরসন করা ইত্যাদি। এই সংস্থার অধীনে বেশকিছু উপসংস্থা রয়েছে। সংস্থার বিস্তৃতি ও উপসংস্থাগুলোর কার্যপরিধি সম্পর্কে একটু ধারণা নেওয়া যাক—
জেনারেল এডমিনিস্ট্রেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের জ্ঞান অর্জনের জন্য অবারিত সুযোগ রেখেছে আল আযহার কর্তৃপক্ষ। এজন্য ফুলফান্ডেড স্কলারশিপ কিংবা টিউশন-ফি মওকুফের ব্যবস্থা রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের জন্য। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা তাদের অধ্যয়ন চালিয়ে নিতে পারে সহজেই। এবং অধ্যয়ন শেষে নিজ নিজ দেশে গিয়ে ইসলামের বিশুদ্ধ বাণী প্রচারে ব্রতী হতে পারে। এক্ষেত্রে ‘জেনারেল এডমিনিস্ট্রেশন ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস’ (আল ইদারাতুল আম্মাহ লিত্তুল্লাবিল ওয়াফিদিন) বিদেশী শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করে থাকে। শিক্ষার্থীদের ভর্তিসংক্রান্ত বিষয়গুলোও পরিচালনা করে এই সংস্থাটি।
মিশর ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আল আযহার তার অধীনে মা’হাদ বা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত করে ইসলামি জ্ঞান বিতরণ করে চলেছে। যারা বিদেশে এসে পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারে না; তারা নিজ দেশে এসব ইন্সটিটিউট থেকে নিজেদের শিক্ষাটা অর্জন করতে পারে। বহির্বিশ্বের এ মাহাদগুলো শিক্ষা-সিলেবাস ও শিক্ষাপদ্ধতিতে আল-আযহারকে অনুসরণ করে থাকে। আল আযহারের মাহাদ কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি ইসলামিক রিসার্চ একাডেমী কর্তৃপক্ষও এসব ইন্সটিটিউটের শিক্ষা-কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করে থাকে।
জেনারেল এডমিনিস্ট্রেশন অভ ইসলামিক মিশনস
ইসলামি মিশন পরিচালনার জন্য আল আযহার বিশেষজ্ঞ আলেমদেরকে বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করে থাকে। বিভিন্ন দেশে চাহিদার ভিত্তিতে যথাযোগ্য ইসলামিক স্কলার, ধর্মতত্ত্ববিদ প্রেরণ করা হয়। তাঁরা ইসলামের সঠিক বিষয়গুলোকে মানুষের মাঝে প্রচার করে থাকেন। এবং অজ্ঞতা, মূর্খতা ও ভুলভাল ব্যাখ্যা নিরসনে সচেষ্ট থাকেন। দেশে দেশে ইসলামের বিশুদ্ধ বাণী প্রচার করেন নিরলসভাবে। প্রায় ৯০ টি দেশে আল-আযহারের বিশেষজ্ঞ এমন আলিমদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
গবেষণা, রচনা ও অনুবাদ প্রকাশনা-সেক্টর
এ সেক্টরের মাধ্যমে ইসলামিক রিসার্চ একাডেমী মুসহাফুল আযহার ছাপা ও প্রচারের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। প্রচলিত মুসহাফের ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কেও বিশেষ সচেতনতা এবং তা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। এছাড়াও এ সেক্টরে বিভিন্ন বিষয়ের গবেষকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয় গবেষণা, মৌলিক রচনা ও অনুবাদ। এবং সেগুলো সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যেনো, জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলেই ইসলামের সুমহান বাণী এবং মূল্যবোধ সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
ফতওয়া কমিটি
ফতওয়া কমিটি ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, টেলিফোন কিংবা চিঠিপত্রের মাধ্যমে ইসলামি ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের আলোকে মানুষের বহুবিধ সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে। এছাড়াও অমুসলিমদের মধ্য থেকে যারা ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলামধর্ম গ্রহণে আগ্রহী হন তাদেরকে এক্ষেত্রে সহযোগিতা করা হয় এবং ইসলামগ্রহণের সনদ প্রদান করা হয়। সেই সঙ্গে ইসলাম গ্রহণের পর এসব ব্যক্তিবর্গ যেনো ইসলামি-শিক্ষা ও আদর্শ সঠিকভাবে অর্জন করতে পারেন, সেই বিষয়টি আল-আযহারের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধান করা হয়।
আল-আযহার লাইব্রেরি
এই লাইব্রেরি বিশ্বের একটি সমৃদ্ধ ও সর্বাধুনিক লাইব্রেরি। এখানে গবেষণার জন্য প্রায় সকল ধরণের প্রাচীন ও দুর্লভ গ্রন্থের সম্ভার রয়েছে। দুর্লভ ও তুরাসি বইপুস্তক সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এ লাইব্রেরির তুলনা নেই। এখানে বিভিন্ন বিষয়ের লক্ষাধিক গ্রন্থ ও অর্ধমিলিয়নের বেশি ভলিয়ম রয়েছে। আর পাণ্ডুলিপি রয়েছে চল্লিশ হাজার। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানপিপাসুরা এখান থেকে এসব দুর্লভ গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন এবং নিজেদের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন বিশ্বমানবতার কল্যাণে। তাছাড়া এ লাইব্রেরীর ১৪ তালা বিশিষ্ট একটা নবনির্মিত ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে। যেখানে পাঠকদের পড়ার জন্য রয়েছে নানাবিধ ব্যবস্থা। গবেষকদের গবেষণার জন্যও রয়েছে বিভিন্ন সুযোগ ও সুবিধা।
মাজাল্লাতুল আযহার
এটি আল আযহার ম্যাগাজিন। প্রতি আরবি মাসের শুরুতে প্রকাশিত হয়। আল আযহারের বার্তা সারাবিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে যার এর মাধ্যমে। এবং এতে সমকালীন ঘটনাবলির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মুসলমানদের বিভিন্ন সংকট ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়াদিও আলোচিত হয় সাময়ীকিটিতে।
সুপ্রিম-কমিটি ফর ইসলামিক দাওয়াহ
এই বিভাগটি প্রতিষ্ঠা করা হয় বিশ্বময় দাওয়াহ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। এই বিভাগ বিভিন্ন দেশের ইমাম, দাঈ ও ইসলামি বক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ-কর্মশালার আয়োজন করে থাকে নিয়মিত। এই কর্মশালা সাধারণত তিনমাস ব্যাপী হয়; এখানে মানুষের কাছে ধর্মীয় বাণী পৌঁছানোর পদ্ধতি শেখানো হয়। ধর্মীয় মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা মানুষের সামনে সহজে উপস্থাপনের কৌশল রপ্ত করানো হয়। ইসলাম বিষয়ে প্রচলিত ভুল ধারণাগুলো নিরসনের জন্য তাগিদ দেওয়া হয় এই কর্মশালায়।
শাইখুল আযহারের ‘শান্তি-কাফেলা’
ইসলামি মূল্যবোধ প্রসারে আল আযহারের কার্যক্রম বিস্তৃত। এজন্য আল-আযহারের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এখানে আল আযহারের প্রধান শাইখুল আযহার ইমাম আহমদ আত-তায়্যিব হাফি. এর বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা করবো। তিনি বিভিন্ন সময়ে আল-আযহারের উদ্যোগে আয়োজিত সভা-সেমিনারে ইসলামের সঠিক মূল্যবোধ যেমন তুলে ধরছেন বিশ্বদরবারে, তেমনি দেশ মহাদেশে আল-আযহার কর্তৃক প্রতিনিধি পাঠিয়ে মানুষের মাঝে ইসলাম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
শাইখুল আযহারের অধীনে ২০১৫ সালে গঠন করা হয় ‘শান্তি কাফেলা’। এই দলের নানারকম কার্যক্রম রয়েছে। ত্রাণকার্যক্রম, দাওয়াহ কার্যক্রম ইত্যাদি বিভিন্ন দলে বিভিন্ন কর্ম সম্পাদন করা হয়। বিভিন্ন দেশে শিক্ষা কার্যক্রম, ধর্মীয় সচেতনতা তৈরিতে সেমিনার সেম্পোজিয়ামের আয়োজন করে থাকে।
শান্তি-কাফেলার ত্রাণকার্যক্রম মানুষের প্রয়োজনে মানবতার হাত প্রসারিত করে থাকে। প্রয়োজন অনুসারে মানুষের জন্য চিকিৎসা ও অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করা হয় এই কাফেলার মাধ্যমে। দেশের ভেতর অর্থাৎ মিশরে এই কার্যক্রম যেভাবে নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে তেমনি বিভিন্ন দেশে মুসলিমদের সংকটকালে এই ত্রাণকাফেলা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০১৪ সালে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ঔষুধ ও চিকিৎসা সামগ্রীসহ প্রায় ৪০ টন খাদ্যসামগ্রী পাঠানো হয় আল-আযহারের পক্ষ থেকে। একইভাবে ২০২১ সালেও ইহুদিদের হামলার পর ফিলিস্তিনে জরুরিভিত্তিতে চিকিৎসা ও খাদ্যসামগ্রী পাঠানো হয়। আফ্রিকা মহাদেশসহ বিভিন্ন দেশে মুসলিমদের সংকটকালে আল-আযহার থেকে ত্রাণসামগ্রী, প্রতিনিধিদল কিংবা সহমর্মিতা প্রকাশ করা হয়।
‘শান্তি-কাফেলা’র লক্ষ্য
এই ‘শান্তি-কাফেলা’ প্রকল্পের লক্ষ্য হলো:
ইসলামের মানবিক দিকের ওপর গুরুত্ব দেওয়া।
সমাজে ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি মুসলিমদের আহবান জানানো। তরুণদের চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের খপ্পরে পড়া থেকে রক্ষা করা। অমুসলিমদেরকে যুক্তি, প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে দাওয়াত দেওয়া। এই সমাজের তরুণদের মনে জেগে ওঠা সংশয়গুলো চিহ্নিত করা। এভাবে তরুণ সমাজকে বিপথে চলে যাওয়া থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে এই কাফেলা কাজ করে যাচ্ছে। মিশরসহ বিশ্বের অনেক দেশেই এই কাফেলার কার্যক্রম লক্ষ্যণীয়। মিশরে এই কাফেলার কার্যক্রম সবচেয়ে ব্যাপক। সমাজের সর্বস্তরের যুবকদের মাঝে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়া এবং তাদের সংশয়গুলো দূর করে থাকে এই কাফেলার প্রতিনিধিরা। তাঁরা বিভিন্ন সময় যুবকদের সংশয়গুলো জানার চেষ্টা করেন; এমনকি কফিশপের আড্ডায়, রেস্টুরেন্টের ভেতরে বসে যুবকদের ধর্মীয় দাওয়াত দিয়ে থাকেন। আর বহির্বিশ্বেও বিভিন্ন দেশের ভার্সিটিতে, ধর্মীয় সভায় ও মসজিদগুলোয় এই কাফেলার প্রতিনিধিরা যুবকদেরকে ইসলামের প্রতি সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেন। যেসব দেশে এই কাফেলা তার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হলো, কেনিয়া, কলম্বিয়া, ফ্রান্স, নাইজেরিয়া, চাঁদ, মধ্য-আফরিকা, দক্ষিণ আফরিকা, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, স্পেন, ইতালি, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র।
ইসলামের এই শান্তিবাণী প্রসারে শাইখুল আযহার ইমাম আহমদ আত-তায়্যিব বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আল-আযহারের পক্ষ থেকে বক্তব্য দিয়ে বিশ্বকে সঠিক ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। এই সভা-সেমিনারে ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান সংরক্ষণের ব্যাপারেও জোর দিয়ে থাকেন। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের হলো:
২০২০ সালে অনুষ্ঠিত ‘আল-আযহার ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন রেনোভেশন অভ ইসলামিক থট’।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনার ‘ইসলাম ও পশ্চিম; বৈচিত্র্য ও একীকরণ’।
এই সেমিনারের প্রতিপাদ্য ছিলো ইসলাম ও পাশ্চাত্যের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে সমসাময়িক পাঠের বিষয়গুলো অধ্যয়ন ও গবেষণার প্রতি গুরুত্বারোপ। বিশেষভাবে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুসারীদের মাঝে সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি করা এবং মানবতার কল্যাণে আসে এমন সকল বিষয়ে কার্যকরভাবে অবদান রাখা।
২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত ‘পবিত্র নগরী জেরুজালেমের সমর্থনে আল-আযহার আন্তর্জাতিক সম্মেলন’। এখানে বৈশ্বিক জনমত আকর্ষণের জন্য ফিলিস্তিনের পক্ষে যুক্তি ও মতামতগুলো জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়।
২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত হয় ‘মায়ানমারের নাগরিকদের জন্য মানবিক সংলাপ’ শীর্ষক সভা। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমদের এবং তাদের ধর্মীয় ও জাতিগত নিপীড়নের বিষয়টি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। সে দেশের আলেমসমাজের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে তাদের সমস্যা সমাধানে বৈশ্বিকভাবে জোর দাবি তোলা হয়।
২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় ‘উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্মেলন’।
এভাবে বৈশ্বিক বিভিন্ন মঞ্চে ইসলাম ও মুসলমানদের পক্ষে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন শাইখুল আযহার ইমাম আহমদ আত-তাইয়্যেব। তিনি আল-আযহারের অবস্থানকে বিশ্বদরবারে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করে যাচ্ছেন সর্বদা। ইসলামোফোবিয়াসহ পশ্চিমাবিশ্বে ইসলাম নিয়ে যেই ভুল ধারণাগুলো জন্মেছে সেসব নিরসনে আল-আযহার কর্তৃপক্ষ নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। সেই সাথে সারাবিশ্বে নিপীড়িত মুসলিমদের জন্যও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে যাচ্ছেন। মোটকথা, ইসলামের বাণী বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে আল-আযহারের ভূমিকাকে আরও বেগবান করে তুলেছেন ইমাম আহমদ আত-তাইয়্যেব।
বিশ ও একুশ শতকের উল্লেখযোগ্য কয়েকজন আলিম
আল-আযহার তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই বিশ্বময় ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞান নিষ্ঠার সাথে প্রচার করে আসছে। এবং আল-আযহার থেকে প্রতিযুগে এমন অনেক বিদ্বন ব্যক্তির জন্ম দিয়েছে, যাদের জ্ঞানের আলোয় পুরো বিশ্ব আলোকিত হয়েছে। তবে আমরা এখানে ২০ শতক ও ২১ শতকের এই সময়কালের কয়েকজন বিদ্যান ব্যক্তি কথা উল্লেখ করবো। যাঁরা আল-আযহার থেকে জ্ঞান অর্জন শেষে নিজ দেশের মানুষকে আলোকিত করেছেন কিংবা করে যাচ্ছেন।
১. ড. আইয়ুব আলী (১৯১৯-১৯৯৫)
তিনি আল-আযহার থেকে ১৯৫৫ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৭৩-১৯৭৯ সময়কালে সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, ঢাকার প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৬ সালে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক লাভ করেন। একাধারে তিনি শিক্ষাবিদ, লেখক ও ইসলামিক স্কলার হিসেবে জীবন অতিবাহিত করেন।
২. ড. মুহাম্মদ মুস্তফা আজমি (১৯৩০-২০১৭)
তিনি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত হাদিসবিশারদ এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রতাপশালী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। যেমম, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অভ মিশিগান, উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি এবং কিং সাউদ ইউনিভার্সিটিসহ আরো অনেক বিখ্যাত ইউনিভার্সিটি।
৩. সাদ জগলুল
মিশরে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রধান সংগঠক এবং বিপ্লবী রাজনীতিবিদ।
৪. শাইখ ইউসুফ আল-কারযাবি (১৯২৬-২০২২)
তিনি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত ফকিহ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অভ মুসলিম স্কলার্স-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
৫. মেহমুদ হেন্ডজিক (১৯০৬-১৯৪৪)
তিনি বসনিয়ান ইসলামিক স্কলার, ধর্মতাত্ত্বিক এবং রাজনীতিবিদ।
৬. মুহাম্মদ মা জিয়ান
তিনি চীনাভাষায় পবিত্র কোরআনের অনুবাদক।
৭. আবু তুরাব আযযাহিরি (১৯২৩-২০০২) ভারতীয় বংশদ্ভূত একজন আরবীয় লেখক। তিনি একাধারে ভাষাবিদ, আইনজীবী, ধর্মতাত্ত্বিক ও সাংবাদিক।
৮. ফাতহুল্লাহ জামিল (১৯৪২-২০১২)
তিনি মালদ্বীপের সুদীর্ঘ ২৭ বছর পপররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এবং আজীবন জাতিসঙ্ঘে মালদ্বীপের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
৯. মামুন আব্দুল গাইয়ুম (জন্ম ১৯৩৭)
তিনি মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৩০ বছর দায়িত্ব পালন করেন।
১০. সাইয়েদ আব্দুর রহমান ইমবিচিকোয়া থাঙ্গাল (১৯২২-২০১৫)
তিনি ইন্ডিয়ার কেরালা রাজ্যের একজন প্রসিদ্ধ ইসলামিক স্কলার।
১১. তহা জাবির আল- আলওয়ানি (১৯৩৫- ২০১৬)
একজন ইরাকি ইসলামিক স্কলার। তিনি ছিলেন ফিকহ কাউন্সিল অভ নর্থ আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
১২. মুহাম্মদ সাইয়েদ তানতাওয়ি (১৯২৮-২০১০) তিনি ছিলেন মিশরের প্রধান মুফতি এবং আল-আযহারের প্রধান বা শাইখুল আযহার।
১৩. আব্দুরর হমান ওয়াহিদ (১৯৪০-২০০৯) তিনি ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট।
১৫. আব্দুল্লাহ সাঈদ (জন্ম ১৯৬৪)
সাবেক প্রধান বিচারপতি, মালদ্বীপ।
১৫. নিক আব্দুল আজিজ নিক মাত (১৯৩১-২০১৫)। তিনি ছিলেন প্যান মালোশিয়ান ইসলামিক পার্টির আধ্যাত্মিক নেতা এবং ক্যালান্টান প্রদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী।
১৬. আলিকো ডাঙোতি (জন্ম১৯৫৭)। নাইজারিয়ান বিজনেস-ম্যাগনেট এবং আফ্রিকা মহাদেশের একজন শীর্ষধনী।
১৭. আব্দুল হাদি আওয়াঙ (১৯৪৭-২০০৪)। তিনি প্যান মালোশিয়ান ইসলামিক পার্টির প্রেসিডেন্ট ও তেরেঙানো প্রদেশের রাজ্যপাল ছিলেন। এবং তিনি ছিলেন প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা।
১৮. ড. সাঈদুর রহমান আজমি নাদাভি (জন্ম ১৯৩৪)। তিনি ভারতের দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামার প্রিন্সিপাল এবং ইন্টিগ্রাল ইউনিভার্সিটির চ্যান্সেলর।
১৯. তিমোথি জন উইন্টার যিনি এখন আব্দুল হামিম মুরাদ নামেও পরিচিত (জন্ম ১৯৬০)। ব্রিটিশ এই নাগরিক প্রতিষ্ঠা করেছেন মুসলিম ক্যাম্ব্রিজ কলেজ। এবং ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটির শিক্ষক।
২০. দালিল বুবকর (জন্ম ১৯৪০)। তিনি ফ্রেঞ্চ কাউন্সিল অভ মুসলিম ওরশিপ এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
এখানে অল্প কয়েকজনের নাম উল্লেখিত হয়েছে মাত্র। এমন হাজার হাজার ইসলামিক স্কলার, ধর্মতাত্ত্বিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ যুগে যুগে আল-আযহার থেকে জ্ঞান আহরণের পর ইসলামের সুধা পান করিয়েছেন বিশ্বকে। মানবাজাতিকে সুন্দর একটা পৃথিবী উপহার দিতে তাঁরা নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছেন। ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা ও ব্যবসাসহ জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে তাঁরা সমানভাবে মানবকল্যাণে কাজ করেছেন। এ এক অনন্য আযহার। যার শীতল ছায়াতলে হাজার বছর ধরে জ্ঞানপিপাসু ছাত্র-ছাত্রীরা ইসলামের সুসমৃদ্ধ জ্ঞান অর্জন করে চলেছেন। এদিকে আল-আযহার জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর দুর্যোগেও পাশে দাঁড়াচ্ছে এবং বিশ্বদরবারে মুসলমানদের পক্ষে আওয়াজ জোরালো করে চলেছে। আবার মুসলিম-অমুসলিম সবার কাছে ইসলামের সঠিক চিত্র উপস্থাপন করছে বিভিন্ন উপায়ে। আল-আযহার সুবিশাল বটবৃক্ষের মতো ছায়া হয়ে থাকুক পৃথিবীর সমাপ্তি পর্যন্ত। আর ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করুক বিশ্বময়।
তথ্যসূত্র :
১. মাজমাউল বুহুসিল ইসলামিয়া।
২. মাওকিউ আলইমাম আততায়িব।
৩. মাওকিউ আল-আযহার আশ-শারিফ।
৪. ইউকিপিডিয়া।
৫. আল-আহরাম ‘আমিনুল বুহুসিল ইসলামিয়া ইয়াসতা‘রিজু জুহুদা মিসরা ওয়াল আযহার ফি নাশরিল ওয়াসাতিয়াহ ওয়াত তসামুহি ফি দুওয়ালিল আ‘লাম’।
লেখক: শিক্ষার্থী : আল-আযহার ইউনিভার্সিটি, মিশর।