ইতিহাস ও সভ্যতার এক অপূর্ব লীলাভূমির নাম মিসর। দজলা-ফুরাত, সিন্ধু ও নীল নদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন তিন সভ্যতা। প্রাচীন মিসরীয় সভ্যতা এ তিন সভ্যতার অন্যতম। মিসরের ফিরআউনি সাম্রাজ্য ও বনু ইসরাইলের ইতিহাস এ সভ্যতায় এনে দিয়েছে এক ভিন্ন বৈশিষ্ট। প্রাচীন মিসরের রাজবংশ পূর্ব যুগ (প্রস্তর যুগ), আদি রাজবংশীয় যুগ (প্রাচীন ব্রোঞ্জ যুগ), প্রথম অন্তর্বর্তী যুগ ও অভ্যন্তরীণ বিশৃংখলা, মধ্য সাম্রাজ্যের যুগ (মধ্য ব্রোঞ্জ যুগ), ইবরাহিম আ. এর মিসর গমন, দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী যুগ ও হেকসোস আধিপত্য, ইয়াকুব আ. ও বনু ইসরাইলের মিসর প্রবেশ, ইউসুফ আ. এর মন্ত্রীত্ব, মুসা আ. ও বনু ইসরাইলের মিসর ত্যাগ, নতুন রাজ্য (শেষ ব্রোঞ্জ যুগ), তৃতীয় অন্তর্বর্তী যুগ এবং আশুরীয় ও কুশিদেরর আধিপত্য, রাজবংশের শাসনের শেষ যুগ, পারসিক শাসনের যুগ (৩৪৩-৩৩২ খ্রি.পূ.), মেসিডোনিয়ার আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেটের মিসর জয় ও তার উত্তরশুরী টলেমি যুগ (৩২৩-৩০ খ্রি.পূ.), রাণী ক্লিওপেট্টার পরাজয় ও টলেমি শাসনের অবসান, রোমান শাসনের যুগ (৩১ খ্রি.পূ.-২৮৪ খ্রি.) ও প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন পরবর্তী বায়জান্টাইন যুগ (২৮৪-৬৪০ খ্রি.)সহ মিসরীয় সভ্যতার প্রতিটি ধাপই পৃথিবীর ইতিহাসের একেকটি কিংবদন্তী অধ্যায়।
ইসলামি বিজয় প্রাক্কালে ৬১৬ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের সাসানি সম্রাট দ্বিতীয় খসরুর আমলে মিসর আবার পারাস্যের আক্রমণের শিকার হয়। এ আক্রমণ দশ বছর স্থায়ী হয়। অবশেষে বায়জান্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে নিনেভের যুদ্ধে পারস্য বাহিনীকে পরাজিত করে মিসর থেকে বিতারিত করে। মিসর ইসলাম পূর্ব ইতিহাসে সর্বশেষ শাসিত হয় বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যের অধীনে। এটিই সেই সাম্রাজ্য ইসলামের আবির্ভাবের পর শামে ও মিসরে মুসলিমরা যে সাম্রাজ্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন। মিসর রোমান সাম্রাজ্যের যুগে যেমন অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভিন্ন জুলুম ও বৈশম্যের শিকার ছিল ঠিক একই অবস্থা বায়জান্টাইন সাম্রাজ্যের যুগেও বহাল ছিল। এ সময় মিসরে কিছু সংখ্যক ইহুদি ও বিপুল সংখ্যক খ্রিষ্টান বসবাস করত। মিসরের মূল অধিবাসী কিবতিরা রোমান যুগে ব্যাপকহারে খ্রিষ্টান ধর্মে দিক্ষিত হয়েছিল।
মুসলিমদের মিসর বিজয় (১৯-৪১ হি./৬৪০-৬৬২ খ্রি.)
প্রাচীনকাল থেকেই আরবদের সাথে মিসরের যোগাযোগ ও বানিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বময় ইসলামের দাওয়াহ ছড়িয়ে দেয়ার মহান লক্ষ্যের অংশ হিসেবেই মুসলিমরা মিসর অভিযান করেন। সেই সাথে ছিল সামরিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন কারণ।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. মিসর বিজয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা। মুসলিম বাহিনীর হাতে বাইতুল মুকাদ্দাস বিজিত হলে ১৮ হিজরিতে জেরুজালেমের পাদ্রীর নিকট হতে আল-কুদসের চাবি গ্রহণ করতে এসে খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. আমর ইবনুল আস রা. ও অন্যান্য মুসলিম সেনাপতিদের সাথে মিসর অভিযানের বিষয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা করেন। এরপর খলিফার নির্দেশে আমর ইবনুল আস রা. এর সেনাপতিত্বে ১৮ হিজরির শেষ দিকে (ডিসেম্বর ৬৩৯ খ্রি.) মুসলিম বাহিনী মিসর অভিযানে বের হয়।
আমর ইবনুল আস রা. ৩০০০-৫০০০ সৈন্যের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে সিনাই উপদ্বীপ হয়ে মিসরে প্রবেশ করেন। ১০ জিলহজ ১৮ হিজরিতে (১২ ডিসেম্বর ৬৩৯ খ্রি.) আরিশ জয় করেন। এরপর সমুদ্র উপকূল থেকে দূরত্ব বজায় রেখে বালুকাময় পথ ধরে পশ্চিমে এগুতে থাকেন। ১২ মুহাররাম ১৯ হিজরিতে (১৩ জানুয়ারি ৬৪০ খ্রি.) ক্ষুদ্র যুদ্ধের পর তিনি মাদিনাতুল ফারামা জয় করেন। এরপর মরুপথ ধরে দক্ষিণে অগ্রসর হন। মাদিনাতু মাজদাল, কানতারা, সালিহিয়া ও তিল আল-কাবির হয়ে রবিউল আউয়াল ১৯ হিজরিতে (মার্চ ৬৪০ খ্রি.) তিনি ডেল্টার বিলবিস শহরে পৌঁছেন। এখান থেকে ব্যাবিলন দুর্গের উত্তরে অবস্থিত উম্মু দুনাইন অঞ্চলে এগিয়ে যান। এসময় খলিফার পক্ষ থেকে নতুন চার হাজার সেনা সাহায্য এসে পৌঁছে। এরপর সংঘটিত হয় রক্তক্ষয়ী আইনু শামস যুদ্ধ। উম্মু দুনাইন ও আব্বাসিয়াতে পেতে রাখা দুটি ফাঁদ এ যুদ্ধে মুসলিমদের বিজয়কে নিশ্চিত করে।
৬৪১ খ্রিস্টাব্দে বায়জান্টাইন সম্রাট হিরাক্লিয়াস মারা যায়। একই বছর ২ মুহাররম ২০ হিজরি (৬ এপ্রিল ৬৪১ খ্রি.) সন্ধির মাধ্যমে মিসরের শাসক মুকাওকিসের কাছ থেকে আমর ইবনুল আস রা. ব্যাবিলন দুর্গ জয় করেন।এরপর মুসলিম বাহিনী খারিজা ইবনু হুজাফাকে ব্যাবিলন দুর্গে নিযুক্ত করে রবিউল আওয়াল ২০ হিজরি (১৮ ফেব্রুয়ারি ৬৪১ খ্রি.) আলেকজান্দ্রিয়া অভিমুখে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে বেশ কিছু যুদ্ধে বিজয় অর্জন করে মুসলিম বাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছে যায় এবং শহরটি অবরোধ করে নেয়। জিলকদ ২০ হিজরি (নভেম্বর ৬৪১ খ্রি.) সন্ধির মাধ্যমে আলেকজান্দ্রিয়া শহর বিজিত হয়। ১৬ শাওয়াল ২১ হিজরি (১৭ সেপ্টেম্বর ৬৪২ খ্রি.) সন্ধির শর্ত অনুযায়ী বায়জান্টাইন বাহিনী রাজধানী আলেকজান্দ্রিয়া খালি করে দেয় এবং ইসলামি বাহিনী আলেকজান্দ্রিয়া প্রবেশ করে। এভাবে দুই বছর চার মাসে মিসর বিজয় সম্পন্ন হয়।
এরপর সমগ্র মিসরে মুসলিমদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়। মিসর ইসলামি সাম্রাজ্যের একটি অংশে পরিণত হয়। আমর ইবনুল আস রা.ইসলামি বাহিনীর অর্ধেক সৈন্য আলেকজান্দ্রিয়া মুতায়েন করেন। আর বাকি অর্ধেক তার নিকট ফুসতাতে রাখেন। নবনির্মিত ফুসতাত শহরকে মুসলিম বাহিনী বিজিত মিসরের নতুন রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করে। এরপর আমর ইবনুল আস রা. বারকা, ত্রিপোলী ও নুবিয়াসহ বেশ কিছু অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে মিসর বিজয়কে নিরাপদ করেন।
মিসরে গভর্নরদের যুগ (২১-২৫৪ হি./৬৪১-৮৬৮ খ্রি.)
২১ হিজরিতে (৬৪২খ্রি.) মিসর বিজয় সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে মিসর ইসলামি খিলাফাতের অংশে পরিণত হয়। ইসলামি বিজয় পরবর্তী মিসরের প্রায় সোয়া দুই শতাব্দীরও অধিককাল সময় ‘গভর্নরদের যুগ’ নামে পরিচিত। রাশিদা খিলাফাত, উমাইয়া খিলাফাত ও আব্বাসি খিলাফাতের শুরুর অংশ পর্যন্ত এ যুগ প্রলম্বিত। এ সময় কেন্দ্রীয় ইসলামি খিলাফাতে পক্ষ থেকে নিযুক্ত গভর্নরগণ মিসর শাসন করতেন এবং মিসরে কেন্দ্রের নির্দেশনা ও রাজনীতি বাস্তবায়ন করতেন। তিনি ‘ওয়ালিউ মিসর’ বা ‘আমিরু মিসর’ নামে মিসরে কেন্দ্রীয় খলিফার প্রতিনিধি গণ্য হতেন। প্রশাসন, সালাত প্রতিষ্ঠা, সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব, খিরাজ ও অন্যান্য বিষয়ে তিনিই দায়িত্বশীল হতেন।
রাশিদা খিলাফাতের যুগ (২০-৪০ হি./৬৪০-৬৬০ খ্রি.): আমর ইবনুল আস রা. ছিলেন ইসলামি মিসরের প্রথম গভর্নরন। খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. তাকে শক্তভাবে মুহাসাবা করতেন এবং খিরাজ ইত্যাদির হিসাব নিতেন। রাশিদা খিলাফাতের যুগে মিসরের গভর্নর নির্ণয়ের মানদণ্ড ছিল- ব্যক্তির উত্তম চরিত্র, আখলাক, যোগ্যতা, সক্ষমতা, যুদ্ধ ও রাজনীতিতে পারদর্শিতা, ইসলামি সাম্রাজ্য ও নির্ধারিত প্রদেশের স্বার্থ ইত্যাদি। রাশিদা যুগে গভর্নরগণ সরাসরি খলিফার অধীনস্থ হতেন।
উমাইয়া খিলাফাতের যুগ (৪১-১৩২ হি./৬৬২-৭৫০ খ্রি.): এ সময় মিসরের গভর্নর নিযুক্ত করা হতো উমাইয়া পরিবারে কোনো সদস্যকে বা তাকে যার পরিপূর্ণ আনুগত্যের বিষয়ে উমাইয়াদের আস্থা ছিল। উমাইয়া খলিফাগণ মিসরের শাসকদের স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনার সুযোগ দিতেন। এ সময়ের শ্রেষ্ঠ গভর্নরদের অন্যতম ছিলেন, আমর ইবনুল আস রা., মাসলামা ইবনু মুখাল্লাদ আল-আনসারি রা. ও আব্দুল আজিজ ইবনু মারওয়ান প্রমুখ। রাশিদা খলিফাগণ ও উমাইয়া খলিফাগণের যুগে মিসরের গভর্নররা ছিলেন শুধুই আরব। এসময় মিসরে কোনো অনারব গভর্নর নিযু্ক্ত হয়নি।
আব্বাসি খিলাফাতের যুগ (১৩২-২৫৪ হি./৭৫০-৮৬৮ খ্রি.) : আব্বাসি যুগে মিসরের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এসময় অনেক পারস্য বংশদ্ভোত ও তুর্কি বংশদ্ভোতও অনারবও মিসরের গভর্নর হন। এসকল অনারব গভর্নরদের অনেকের প্রতিই মিসরবাসী ছিল বিরক্ত। কারণ, তারা দ্রুত ধনবান হতে জনগণের উপর অধিকহারে কর চাপিয়ে দিত। যা দেশটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল। আব্বাসি খিলাফাতের যুগে ব্যাপকহারে গভর্নর পরিবর্তন হতো। বিশেষ করে আমিন ও মামুনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সময়ে। মিসর আব্বাসি রাজধানী বাগদাদ বা সামিরা থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ায় আব্বাসিরা মিসরে কোনো গভর্নরকে বেশিদিন দায়িত্বে রাখতেন না।
গভর্নরদের যুগে মিসরের প্রথম রাজধানী ছিল ফুসতাত। এরপর আব্বাসিদের আগমন ঘটলে তারা মদিনাতুল আসকার নির্মাণ করে এটিকে ইসলামি মিসরের দ্বিতীয় রাজধানী হিসেবে গ্রহণ করে। এ যুগে মিসর যেহেতু সরাসরি কেন্দ্রীয় খলিফার তত্ত্বাবধানে শাসিত হতো তাই কেন্দ্রীয় খিলাফাতের ঘটনাবলীর প্রভাবগুলো মিসরেও প্রতিফলিত হত। উসামান ইবনু আফফান রা. এর হত্যাকাণ্ড, আলি রা. ও মুয়াবিয়া রা. এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব, আব্দুল্লাহ ইবনু জুবাইর রা. এর খিলাফাত প্রতিষ্ঠা ও উমাইয়া খিলাফাতের পতনসহ বিভিন্ন ঘটনার সরাসরি প্রভাব পরে মিসরের ভূখণ্ডে।
গভর্নরদের যুগেই মিসরে ব্যাপকহারে ইসলাম ও আরবি ভাষার প্রসার ঘটে। পূর্বে মিসরীয় জনগণের সিংহভাগই ছিল খ্রিস্টান এবং স্বল্প সংখ্যক ইয়াহুদি। ইউনানি ভাষা ছিল দিওয়ানের ভাষা এবং কিবতি ভাষা ছিল পরস্পর কথোপকথনের ভাষা। এক পর্যায়ে ধর্ম ও ভাষা পরিবর্তীত হয়ে সমগ্র মিসরই আরবি ইসলামি রূপে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
মিসরে তুলুনি রাজ্যের যুগ (২৫৪-২৯২ হি./৮৬৮-৯০৫ খ্রি.)
আব্বাসি খিলাফাতের দ্বিতীয় পর্বের শুরুর দিকে খলিফাদের দুর্বলতার সুযোগে কেন্দ্রে তুর্কিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলের শাসকরা নিজেদের অধীনস্থ অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন হতে আরম্ভ করে। এসময় রমাদান ২৫৪ হিজরিতে (সেপ্টেম্বর ৮৭৮ খ্রি.) আহমাদ ইবনু তুলুন মিসরের গভর্নর আমির বাকবাকের পক্ষ্য থেকে নায়েব হিসেবে মিসর গমন করেন। প্রথমে তিনি শুধু ফুসতাতের নায়েব ছিলেন। অনেক প্রতিকূলতার মুকাবিলা করে আব্বাসি খলিফা মুতামিদের যুগে তিনি মিসরের গভর্নর পদে উন্নিত হন। মিসরজুড়ে তার আধিপত্য বৃদ্ধি পেলে তিনি কেন্দ্র হতে ক্রমেই স্বাধীন হতে থাকেন।
আব্বাসি খলিফা আল-মুতামিদ (২৫৫-২৫৬ হি.) ফিলিস্তিন ও জর্ডানে আহমাদ ইবনু ইসার বিদ্রোহ দমন করতে আহমাদ ইবনু তুলুনকে তলব করলে এ সুযোগে তিনি বিলাদুশ শামেও নিজের আধিপত্য বিস্তার করেন। এক পর্যায়ে তার রাজ্যসীমা পশ্চিমে বারকা থেকে পূর্বে ইরাক এবং উত্তরে বায়জান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে দক্ষিণে নুবিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। খলিফা আল-মুতামিদ আলাল্লাহ ও তার ভাই আল-মুওয়াফফাকের মধ্যে বিবাদের সূত্র ধরে তিনি কেন্দ্রীয় খিলাফাত মিসরে স্থানান্তরেরও চেষ্টা করেন। তিনি কেন্দ্রীয় খলিফাকে তার ভাইয়ের প্রভাবমুক্ত রাখতে যথেষ্ট চেষ্টা করেন। কেন্দ্রীয় খিলাফাতের সাথে রেষারেষির জের ধরে এক পর্যায়ে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৬ বছর মিসর শাসন করে ১০ জিলকদ ২৭০ হিজরিতে (মে ৮৮৩ খ্রি.) আহমাদ ইবনু তুলুন ইন্তেকাল করেন। মাদিনাতুল কাতায়ি, জামে আহমাদ ইবনু তুলুন, কানাতিরু ইবনি তুলুন, আল-বিমারিস্তান আত-তুলুনি তার অনন্য কৃতিত্ব।
তার ইন্তেকালের পর তার পুত্র খামারাবিহ ইবনু আহমাদ ইবনু তুলুন (২৭০-২৮২ হি./৮৮৩-৮৯৫ খ্রি.) মিসরের শাসক হন। তিনি ৩২ বছর মিসর শাসন করেন। এরপর তার দুই পুত্র আবুল আসাকির জাইশ (২৮২-২৮৩ হি./৮৯৫-৮৯৬ খ্রি.) ও আবু মুসা হারুন (২৮৩-২৯২ হি./৮৯৬-৯০৪ খ্রি.) মিসর শাসন করেন। পরবর্তীতে মিসর শাসন করেন শাইবান ইবনু আহমাদ ইবনু তুলুন (২৯২-৯০৪ খ্রি.) । এরপর তুলুনি রাজ্যের পতন ঘটে। ২৯২ হিজরির সফর মাসের শেষ দিকে আব্বাসি খিলাফাতের পক্ষ থেকে মুহাম্মাদ ইবনু সুলাইমান ফুসতাত প্রবেশ করেন এবং তুলুনি রাজ্যেপর পতন ঘটান। তুলুনিরা মাত্র ৩৮ বছর মিসর শাসন করে। আব্বাসিরা শুধু জামে আহমাদ ইবন তুলুন বাকি রেখে সমগ্র মাদিনাতুল কাতায়ি আগুনে জ্বালিয়ে দেয় এবং সকল তুলুনি নিদর্শন ধ্বংস করে ফেলে।
মিসরে দ্বিতীয় আব্বাসি যুগ (২৯২-৩২৩ হি./৯০৫-৯৩৫ খ্রি.)
এরপর মিসর আবার আব্বাসি খিলাফাতের অনুগত প্রদেশে পরিণত হয়। প্রায় ৩০ বছর আব্বাসি খিলাফাতের অনুগত থাকে। আব্বাসি খলিফার নামে খুতবা পাঠ করা হয়। এ সময়ে আব্বাসি গভর্নরদের পক্ষ থেকে এগারো জন খলিফা মিসর শাসন করেন। তাদের অন্যতম ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনু সুলাইমান আল-কাতিব ও ইসা ইবনু মুহাম্মাদ আন-নাওশারি। এ সময় মিসরে বিশৃংখলা বিরাজ করে। ২৯৬ হিজরিতে ফাতিমিরা বিলাদুল মাগরিবে আগালিবা রাজ্যের পতন ঘটিয়ে নিজেদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল। এ যুগে ফাতিমিরাও মিসরে অভিযান চালায়।
মিসরে ইখশিদি রাজ্যের যুগ (৩২৩-৩৫৮ হি./৯৩৫-৯৬৯ খ্রি.)
আব্বাসি-ফাতিমি দ্বন্দ্বের সময় মুহাম্মাদ ইবনু তাগাজ আল-ইখশিদির আত্নপ্রকাশ ঘটে। পরবর্তীতে তিনি মিসরে প্রায় স্বাধীন একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ফাতিমিদের বিরুদ্ধে বিজয়ের পুরস্কার স্বরূপ আব্বাসি খলিফা আর-রাজি বিল্লাহ তাকে ইখশিদ উপাধি দিয়েছিলেন। তার উপাধি অনুসারেই এ রাজ্যের নাম রাখা হয় ‘ইখশিদি রাজ্য’।
রমজান ৩২৩ হিজরিতে (৯৩৫ খ্রি.) তিনি গভর্নররূপে মিসর প্রবেশ করেন। নানান প্রতিকূলতার মুকাবিলা করে এগিয়ে যান। খলিফা আর-রাজির ইন্তেকালের পর তার ভাই আল-মুত্তাকি বিল্লাহ (৩২৯-৩৩৩ হি.) খলিফা হন। তিনি মুহাম্মাদ ইবনু তাগাজকে মিসরের গভর্নর হিসেবে বহাল রাখেন। একই বছর মুহাম্মাদ ইবনু তাগাজ তার পুত্র আবুল কাসিম (আনুজুর) এর পক্ষে বায়আত গ্রহণ করেন। তাকে উত্তরাধিকার নিযুক্ত করেন। যা ছিল অনেকটা স্বাধীনতার ঘোষণা । খলিফা তা মেনে নেন। ৩৩২ হিজরিতে (৯৪৪ খ্রি.) মুহাম্মাদ ইবনু তাগাজও মিসরে খিলাফাত স্থানান্তরেও চেষ্টা করেন।
রবিউল আখর ৩২৪ হিজরিতে (৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি তার ভাই উবায়দুল্লাহ ইবনু তাগাজের নেতৃত্বে আলেকজান্দ্রিয়ায় ফাতিমি অভিযান প্রতিহত করেন। এরপর দীর্ঘ এক যুগে ফাতিমিরা আর মিসর অভিযানের সাহস করেনি। এগারো বছর মিসর ও শাম শাসন করে ৩৩৪ হিজরির জিলহজ মাসে মুহাম্মাদ ইবনু তাগাজ আল-ইখশিদ দামেস্কে ইন্তেকাল করেন।
এরপর পর্যায়ক্রমে আবুল কাসিম আনুজুর (৩৩৪-৩৪৯ হি./৯৪০-৯৬০ খ্রি.), আলি ইবনু ইখশিদ (৩৪৯-৩৫৫ হি./৯৬০-৯৬৫ খ্রি.) ও কাফুর আল-ইখশিদি (৩৫৫-৩৫৭ হি./৯৬৫-৯৬৭ খ্রি.) মিসর শাসন করেন। কাফুরের শাসনামলে আল-মুয়িজ লি-দিনিল্লাহ আল-ফাতিমি মিসর দখলের চেষ্টা করেন। কাফুর ফাতিমিদের প্রতিহত করেন। এরপর আবুল ফাওয়ারিস আহমাদ ইবনু আলি আল-ইখশিদ মিসরের ক্ষমতায় আসেন। তার যুগে ৩৫৮ হিজরিতে (৯৬৮ খ্রি.) ফাতিমি খলিফা আল-মুয়িজ লি-দিনিল্লাহ তার সেনাপতি জাওহার আস-সিকিল্লির নেতৃত্বে মিসরে অভিযান চালান। এ বাহিনী ইখশিদিদের পতন ঘটিয়ে মিসরে প্রবেশ করে।
মিসরে ফাতিমি সাম্রাজ্যের যুগ (৩৫৮-৫৬৭ হি./৯৬৯-১১৭১ খ্রি.)
ফাতিমিরা শিয়াদের ইসমাঈলিয়া ফিরকার অন্তর্ভুক্ত। রবিউল আখর ২৯৭ হিজরিতে উবায়দুল্লাহ আল-মাহদি সিজিলমাস্সায় ফাতিমি (উবায়দিয়া) সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় এবং খিলাফাতের বাইয়াত গ্রহণ করে। বিলাদুল মাগরিব থেকে ৩৬২ হিজরিতে ফাতিমি সাম্রাজ্য মিসরে স্থানান্তরিত হয়।
প্রথম ফাতিমি হামলা (৩০১-৩০২ হি./৯১৩-৯১৪ খ্রি.), দ্বিতীয় ফাতিমি হামলা (৩০৭-৩০৯ হি./৯১৯-৯২১ খ্রি.) ও তৃতীয় ফাতিমি হামলা (৩২৩ হি./৯৩৪ খ্রি.) ব্যর্থ হলেও ফাতিমি খলিফা আল-মুয়িজ লি-দিনিল্লাহ (৩৪১-৩৬৫ হি.) কর্তৃক প্রেরিত সেনাপতি জাওহার আস-সিকিল্লি এক লক্ষ সৈন্য নিয়ে ইখশিদিদের পরাজিত করে শাবান ৩৫৮ হিজরিতে (৯৬৮ খ্রি.) বিজয়ীরূপে মিসর প্রবেশ করে। এরপর জাওহার আস-সিকিল্লি চার বছর (৩৫৮-৩৬২ হি./৯৬৯-৯৭২ খ্রি.) মাগরিবের ফাতিমি খলিফা আল-মুয়িজ লি-দিনিল্লাহর নায়েব হিসেবে মিসর শাসন করেন। পরবর্তীতে বিলাদুল মাগরিব থেকে ফাতিমি সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং মিসরই ফাতিমিদের মূল কেন্দ্র হয়ে উঠে। এখান থেকে তারা বিলাদুশ শামসহ বিস্তৃত ভূখণ্ডেরও অধিপতি হয়।
প্রথম ফাতিমি যুগের (৩৬২-৪৮৭ হি./৯৭২-১০৯৪ খ্রি.) খলিফারা ছিল খুবই শক্তিশালী। তারা আব্বাসিদের নামে খুতবা বন্ধ করে দেয়। সুন্নি মুসলিমদের উপর নানাবিধ জুলুম-অত্যাচার করে। প্রকাশ্যে ইসলামি আকিদা-বিশ্বাসের উপর আঘাত হানে। শেষ দিকে এসে ফাতিমি খলিফাদের মধ্যে দুর্বলতা ছেয়ে যায়। রাজ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি হয় এবং বদর জামালির মন্ত্রীত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যে মন্ত্রীদের প্রভাব চরম আকার ধারণ করে। মুস্তালিয়া-নিজারিয়া দ্বন্দ্বের সময় হাসান ইবনু সাবাহ নিজারের পক্ষ অবলম্বন করলে পরিস্থিতি খুবই খারাপ হয়ে যায়। আল-মুস্তালি ইবনুল মুস্তানসির (১০৯৪-১১০১ খ্রি.) এর যুগেই ইউরোপীয় খ্রিস্টান বিশ্বের পক্ষ থেকে প্রথম ক্রুসেড অভিযান পরিচালিত হয় এবং ক্রুসেডাররা ফাতিমি সৈন্যদের পরাজিত করে বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে নেয়।
ফাতিমি শিয়া শাসকরা যখন অন্তর্দণ্ডে লিপ্ত তখন বিলাদুশ শামের জিনকি সাম্রাজ্যে বীর সুলতান নুরুদ্দিন জিনকি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছিলেন। ফাতিমিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে খলিফা আজ-জাফির বি-আমরিল্লাহ (১১৪৯-১১৫৪ খ্রি.) এর যুগে মন্ত্রী শাওয়ির ইবনু মুজিরকে মিসর থেকে তাড়িয়ে দেয়া হলে তিনি সুলতান নুরুদ্দিন জিনকির শরণাপন্ন হন। সুলতান নুরুদদ্দিন জিনকি মন্ত্রীর আবেদনের প্রেক্ষিতে আসাদুদ্দিন শেরকুহকে মিসর অভিযানে প্রেরণ করেন। এ অভিযানে তার সাথে সালাহুদ্দিন আইউবিও ছিলেন। এভাবে মিসরে সালাহুদ্দিন আইউবির অবস্থান তৈরি হয় এবং তিনি সুলতান নুরুদ্দিন জিনকি পক্ষ থেকে শেষ ফাতিমি খলিফা আল-আজিদ লি-দিনিল্লাহ (১১৬০-১১৭১ খ্রি.) এর মন্ত্রী হন। ফাতিমিরা ক্রুসেডারদের সাথে আঁতাত করলে ৫৬৬ হিজরিতে (১১৭১ খ্রি.) সুলতান নুরুদ্দির জিনকির নির্দেশে খুতবা থেকে ফাতিমি খলিফার নাম বাদ দিয়ে আব্বাসি খলিফা আল-মুস্তাজি লি-আমরিল্লাহর নামে খুতবা পাঠ করা হয়। ফাতিমি খলিফা আল-আজিদ তখন অসুস্থ। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ফাতিমি খিলাফাতের বিলুপ্তি ঘটে।
ফাতিমিরা ২০২ বছর মিসর শাসন করে। তারা বিলাসী, অপব্যায়ী ও খ্যাতিপ্রিয় শাসক ছিল। স্থাপত্য ও নির্মাণ শিল্পে অনেক গুরুত্ব দিত। তাদের হাতে কায়রো শহর নির্মিত হয়। জামিউল আজহার, জামিউল হাকিম, জামিউ ইবনিস সালিহ তালায়ি ও আল-জামিউল আকমারসহ অনেক-মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়। এসবেরর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠার পিছনেই উদ্দেশ্য ছিল শিয়া মতবাদের প্রচার-প্রসার। নিজেদের মতাদর্শের প্রচারের জন্য তারা অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা ও গ্রন্থাগার তৈরি করে। আমোদ-প্রমোদের জন্য তৈরি করে অনেক বাগ-বাগিচা। বর্তমান কায়রো শহর ফাতিমি যুগের বিভিন্ন নিদর্শনে পরিপূর্ণ।
মিসরে আইউবি সাম্রাজ্যের যুগ (৫৬৯-৬৪৯ হি./১১৭৪-১২৫০ খ্রি.)
সুলতান গাজি সালাহুদ্দিন ইউসুফ ইবনু আইউব এ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ১১৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দে বিলুপ্ত হয়। খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে এ সাম্রাজ্যের অবদান সর্বাধিক। আটজন মহান সুলতান পর্যায়ক্রমে এ সাম্রাজ্যটি শাসন করেন। তারা হলেন, গাজি সালাহুদ্দিন আল-আইউবি (১১৭৪- ১১৯৩ খ্রি.), আল আজিজ ইবনু সালাহুদ্দিন (১১৯৩-১১৯৮ খ্রি.), আল-মানসুর নাসিরুদ্দিন মুহাম্মাদ (১১৯৮-১২০০ খ্রি.), আল-আদিল সাইফুদ্দিন ইবনু আইউব (১২০০-১২১৮ খ্রি.), আল-কামিল ইবনুল আদিল (১২১৮-১২৩৮ খ্রি.), আল-আদিল আস-সানি সাইফুদ্দিন ইবনু আল-কামিল (১২৩৮-১২৪০ খ্রি.), আস-সালিহ ইবনু আল-কামিল নাজমুদ্দিন আইউব (১২৪০-১২৪৯ খ্রি.) ও আল-মুআজ্জাম গিয়াসুদ্দিন তুরান শাহ (১২৪৯-১২৫০ খ্রি.)। তুরান শাহ মামলুকদের বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে পদচ্যুত করলে এবং তার পিতার স্ত্রী শাজারাতুদ দুরের সাথে দুর্ব্যবহার করলে তারা তাকে হত্যা করে। তিনিই আইউবি সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান।
আইউবি সাম্রাজ্য ছিল মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে নিবেদিত একটি সাম্রাজ্য। সুলতান সালাহুদ্দিন আইউবি শাসক হয়ে মিসরের শিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে দিয়ে আহলুস সুন্নাহর আদর্শকে সমুন্নত করেছিলেন। সুলতান নুরুদ্দিন জিনকির ইন্তেকালের পর তিনি ক্রমান্বয়ে দামেস্ক, হিমস, আলেপ্পো, ফিলিস্তিন ও হিজাজ নিজের অধীনে নিয়ে নেন। খ্রিষ্টানদের থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করেন এবং দ্বিতীয় ক্রুসেডের মুকাবিলা করে ঐতিহাসিক হিত্তিনের যুদ্ধে জয়লাভ করেন। তিনি তৃতীয় ক্রুসেডেরও মুকাবিলা করেন; যা রমাল্লার সন্ধির মাধ্যমে সমাপ্ত হয়।
পরবর্তীতে আল-আদিল সাইফুদ্দিন ইবনু আইউব ভূমধ্য সাগরের তীরে চুতর্থ ক্রুসেড অভিযানের মুকাবিলা করেন। আল-কামিল ইবনু আল-আদিল (১২১৮-১২৩৮ খ্রি.) মিসরের দিমইয়াত উপকূলে পশ্চম ক্রুসেড অভিযানের মুকাবিলা করেন। আস-সালিহ ইবনু আল-কামিল নাজমুদ্দিন আইউবের যুগে দিমইয়াত উপকূলে সপ্তম ক্রুসেড অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযান চলাকালে তার মৃত্যু হলে তার স্ত্রী শাজারাতুদ দুর মৃত্যু সংবাদ গোপন রেখে বাহিনী পরিচালনা করেন। এ সময় রুকনুদ্দিন বায়বার্সের নেতৃত্বে মামলুক বাহিনী অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে এবং ক্রুসেডারেদের পরাজিত করে।
মিসরে মামলুক খিলাফাতের যুগ (৬৪৯-৯২২ হি./১২৫২-১৫১৭ খ্রি.)
আইউবি সুলতান নাজমুদ্দিন আইউব তুর্কিস্তান ও কাকেশাসের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মামলুকদের ক্রয় করে মিসরে নিয়ে এসেছিলেন। উৎসগতভাবে তারা তুর্কি, মোঙ্গল ও সার্কাসিয়ান জাতির অন্তর্ভুক্ত। সপ্তম ক্রুসেড অভিযানের মুকাবিলায় অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে তাদের আত্নপ্রকাশ ঘটে। শাজারাতুদ দুর সিংহাসনে বসলে আব্বাসি খলিফা মিসরের নেতৃবৃন্দকে ভর্ৎসনা করে এবং আরও অনেক মুসলিম নেতা এতে দ্বিমত করে। এসময় শাজারাতুদ দুর মামলুকদের মধ্য থেকে আল-মুয়িজ ইজ্জুদ্দিন আইবেককে মিসরের সিংহাসনে বসালে মামলুক সাম্রাজ্যের সূচনা ঘটে।
মামলুকরা দুইটি দলে বিভক্ত ছিল। বাহরিয়া মামলুক ও বুরুজিয়া মামলুক। ৬৪৮-৭৮৪ হি./ ১২৫০-১৩৮২ খ্রি. বাহরিয়া মামলুকরা মিসর শাসন করে এবং ৭৮৪-৯০৬ হি./ ১৩৮২-১৫১৭ খ্রি. বুরুজিয়া মামলুকরা মিসর শাসন করে। আল-মুজাফফার সাইফুদ্দিন কুতজ, আজ-জাহির রুকুনুদ্দিন বায়বার্স, আল-মানসুর সাইফুদ্দিন কালাউন ও আল-আশরাফ কাইতবাঈ প্রমুখ মামলুক সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ শাসক।
সুলতান সাইফুদ্দিন কুতজ ১২৬০ খ্রিষ্টাব্দে আইনু জালুতের যুদ্ধে দুধর্ষ তাতারিদের পরাজিত করে বিশ্বকে মোঙ্গল তাণ্ডব থেকে রক্ষা করেন। আজ-জাহির রুকুনুদ্দিন বায়বার্স তার পুরো শাসনামল উম্মাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কাটান। বিলাদুশ শাম থেকে ক্রুসেডারদের বিতারিত করেন, তাতারিদের প্রতিহত করেন ও বাতিনি হাশিশি সাবাঈ ঘাতক চক্রকে কোনঠাসা করেন।
আব্বাসি খলিফা আল-মুস্তাসিম তাতারিদের হাতে নিহত হওয়ার পর তার চাচা সুলতান রুকনুদ্দিন বায়বার্সের নিকট চলে আসেন। সুলতান তাকে সম্মান প্রদর্শন করেন এবং ধর্মীয় কর্তৃত্ব দিয়ে খলিফা উপাধিতে ভূষিত করেন। একই সাথে নিজের নামে ও খলিফার নামে মুদ্রা প্রবর্তন করেন। মিসরে চার মাজহাবের কাজি নিয়োগ দেন। প্রজাদের উত্তমরূপে খোঁজ-খবর নেন। অনেক জনকল্যাণমূলক কাজ করেন। দুর্গ নির্মাণ করে সাম্রাজ্যকে শক্তিশালী করেন। আল-মাসজিদুল হারাম সংস্কার করেন এবং নিজ হাতে গোলাপ জল দিয়ে কাবা ধুয়ে দেন। আল-আশরাফ কাইতবাঈ আলেকজান্দ্রিয়া উপকূলে বিখ্যাত কাইতবাঈ দুর্গ নির্মাণ করেন। আন্দালুসের মুসলিমরা তার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলে তিনি খ্রিষ্টান বিশ্বকে হুমকি দেন এবং তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করেন।
আল-আশরাফ তুমান বে আস-সানি (১৫১৬-১৫১৭ খ্রি.) মামলুক সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান। উসমানি সাম্রাজ্যের পরাক্রমশালী সুলতান সেলিমের সাথে যুদ্ধে ২২ জানুয়ারি ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি পরাজিত হলে মিসরে মামলুক শাসনের অবসান ঘটে। ২৬ জানুয়ারি সুলতান সেলিম কায়রো প্রবেশ করেন। মিসরে শুরু হয় উসমানি খিলাফাতের যুগ।
মিসরে উসমানি খিলাফাতের যুগ (৯২২-১৩৩৩ হি./১৫১৭-১৯১৪ খ্রি.)
উসমানি সাম্রাজ্যের ঘোরতর শত্রু ইরানের শিয়া সাফাবি সাম্রাজ্য ও পর্তুগীজদের সাথে মামলুকদের সখ্যতার সূত্র ধরে উসমানি সুলতান সেলিম মামলুকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালান এবং মামলুকদে পরাজিত করে ২৬ জানুয়ারি ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে কায়রো প্রবেশ করেন। এরপর থেকে মিসর বিশাল উসমানি সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়।উসমানিগণ তখন একই সাথে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়া তিন মহাদেশজুড়ে রাজত্ব করতেন। মিসর ছিল উসমানি সাম্রাজ্যের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রদেশ। ফ্রান্স, বিটেন ও পর্তুগালসহ ক্রমবর্ধমান ইউরোপীয় শক্তিগুলো তখন মিসর দখলের জন্য মড়িয়া হয়ে ছিল।
মিসরে ফরাসি অভিযান (১২১৩-১২১৬ হি./১৭৯৮-১৮০১ খ্রি.): ১৭৯৮ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মিসর অভিযান করেন। এ সময় পর্যায়ক্রমে তিনজন ফরাসি শাসকের অধীনে মিসর শাসিত হয়। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৯৮-১৭৯৯ খ্রি.), সেনাপতি ক্লেবার (১৭৯৯-১৮০০ খ্রি.) ও সেনাপতি মিনো (১৮০০-১৮০১ খ্রি.)।
মিসর থেকে ফরাসিদের বিতারণে আল-আজহারের গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। জনগন ফরাসি অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে জিহাদ ও বিপ্লবের স্নোগান দিতে দিতে আল-আজহারে আসে এবং মাশায়িখুল আজহারের শরণাপন্ন হয়। আল-আজহার তখন ছিল ফরাসি বিরুধি আন্দোলনের ঘাটি। আজহারি শাইখগণ এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। ফরাসিরা আন্দোলনকারীদের দমাতে গুলিবর্ষন করে। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট মুকাত্তাম পাহাড়ের চূড়া থেকে আল-আজহারের দিকে কামান তাক করে রাখে। এরপর দুই দিন পর্যন্ত আল-আজহার মসজিদকে ফরাসি সৈন্যদের ঘোড়ার আস্তাবল বানিয়ে রাখে। আল-কুরআনকে পদদলিত করে। এতে মিসরীয় জনগণ আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। উসমানি খিলাফাত ফরাসিদের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। কুটনৈতিক শত্রুতার জের ধরে ব্রিটিশরাও ফরাসিদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ১৩ মার্চ ১৮০১ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসিরা পরাজিত হয়। ১৫ অক্টোবর ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে তারা পরিপূর্ণরূপে মিসর ত্যাগ করে।
মিসরে মুহাম্মাদ আলি পাশা ও তার পরিবারের যুগ (১৮০৫-১৮৪৮ খ্রি.) : ফরাসিদের মিসর ত্যাগের পর তিনটি শক্তি মিসর দাবি করে। উসামানি খিলাফাত, মামলুক ও ব্রিটিশ। ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে উসমানি খিলাফাত খসরু পাশাকে মিসেরর গর্ভনর হিসেবে প্রেরণ করে। এরপর কিছুকাল বিশৃংখলা শেষে ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ আলি পাশা উসমানি খিলাফাতের অনুমোদনের সাথে মিসরের গভর্নর হয়। ১৮১১ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মাদ আলি পাশা মামলুকদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের দুর্গে আবরুদ্ধ করে গণহত্যা চালান। উসমানি খিলাফাতের সাথেও মুহাম্মাদ আলি পাশার তেমন সুসম্পর্ক ছিল না। তিনি একজন শক্তিশালী শাসক হিসেবে অল্প সময়েই মিসরকে উন্নতি ও খ্যাতির সুউচ্চ শিখরে নিয়ে যান। উসমানি খিলাফাতের আহ্বানে হিজাজের ওয়াহাবি আন্দোলন দমন করেন। বিলাদুশ শাম ও হিজাজে রাজ্য বিস্তার করেন। সুদান জয় করেন। এমনকি এক পর্যায়ে তিনি উসমানিদের সাথে দ্বন্দ্বের সূত্র ধরে ইস্তাম্বুলের উপকণ্ঠে গিয়ে পৌঁছেন। পরবর্তীতে উসমানি খিলাফাতের সাথে তার সন্ধি হয়। সন্ধিতে তার ইন্তেকালের পর মিসরে তার বংশধরদের শাসনের স্বীকৃতিও দেয়া হয়। ২ আগস্ট ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইন্তেকাল করেন। আধুনিক কায়রো শহর তার অনন্য কৃতিত্ব। তার সময়ে মিসর কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, প্রশাসন ও সামরিক সার্বিক দিক দিয়ে উন্নতি সাধন করে। তার ইন্তেকালের পর তার বংশধরদের মধ্য থেকে প্রথম আব্বাস (১৮৪৮-১৮৫৪ খ্রি.), মুহাম্মাদ সাঈদ পাশা (১৮৫৪-১৮৬৩ খ্রি.), খেদিভি ইসমাঈল (১৮৬৩-১৮৭৯ খ্রি.) ও খেদিভি মুহাম্মাদ তাওফিক পাশা (১৮৭৯-১৮৯২ খ্রি.) প্রমুখ মিসরের খেদিভি পদে সমাসীন হয়। তাওফিক পাশা মুহাম্মাদ আলি বংশের শেষ শাসক। ব্রিটিশ ও ফরাসি চাপে পড়ে উসমানি সুলতান আব্দুল হামিদ আস-সানি অনিচ্ছা সত্তেও এক ফরমান প্রেরণ করে তাকে গভর্নর নিযুক্ত করেছিলেন। এ সময় মিসরে ইরাবি বিপ্লবও ঘটে। মিসরে ব্রিটিশ আধিপত্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।
মিসরে ব্রিটিশ শাসন ও স্বাধীনাত আন্দোলন : ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানি খিলাফাত জড়িয়ে পরলে মিসর উসমানিদের হাতছাড়া হয়ে ব্রিটিশদের অধীনে চলে যায়। ব্রিটিশ ঐপনিবেশিক যুগে মিসরের জননগণ নানান ভোগান্তির শিকার হয়। একের পর এক বিপ্লব সংঘটিত হতে থাকে। মিসর শাসনের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা দেশীয় ক্ষমতা লোভীদের ব্যবহার করত। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে ইঙ্গ-মিসরীয় চুক্তি অনুসারে ক্ষমতায় আসা রাজা ফারুক ছিলেন এমনি একজন। মিসীয় জনগণ ও আল-আজাহরের স্বাধীনচেতা ছাত্র –শিক্ষকদের আন্দোলন ও প্রতিবাদের চাপে পরে ব্রিটিশরা বারবার মিসর ত্যাগের কথা বললেও সুয়েজ খালের আন্তর্জাতিক সুবিধা ধরে রাখতে যেকোনো ভাবে তারা এখানে তাদের সামরিক উপস্থিতি বহাল রাখত। অবশেষে ৭২ বছরের শাসন-শোষনের পর ১৩ জুলাই ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা পরিপূর্ণরূপে মিসর ত্যাগ করে। পোর্ট সাইদ থেকে শেষ বৃটিশ সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়।
উপসংহার
২৩ জুন ১৯৫৬ সালে নতুন সংবিধান প্রণিত হয় এবং জামাল আব্দুন নাসির মুহাম্মাদ নাজিবের পরবর্তী শাসক হিসেবে মিসরের প্রধানন্ত্রী নির্বাচিত হন। এরপর আনোয়ার সাদাত, হুসনি মুবারাক, মুহাম্মাদ মুরসি ও প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আস-সিসি পর্যাক্রমে স্বাধীন মিসরের শাসন ক্ষমতায় বসেন। বর্তমান আরব প্রজাতন্ত্র মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দুল ফাত্তাহ আস-সিসি সামরিক শাসক হিসেবে মিসর শাসন করে যাচ্ছে।
সহায়ক গ্রন্থবলী
১. আল-কামিল ফিত তারিখ, ইবনুল আসির।
২. আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনু কাসির।
৩. সিয়ারু আলানি নুবালা, জাহাবি।
৪. হুসনুল মুহাদারা ফি তারিখি মিসর ওয়াল কাহিরা, আস-সুয়ুতি।
৫.আল-ইবার, ইবনু খালদুন।
৬. ফুতুহু মিসর ওয়া আখবারুহা, ইবনু আবদিল হাকাম।
৭. মাওসুআতুত তারিখিল ইসলামি, আহমাদ শালাবি।
৮. আত-তারিখুল ইসলামি, মাহমুদ শাকির।
৯. মুহাদারাত ফি তারিখি মিসর আল-ইসলামিয়া, ডক্টর আব্দুল হাদি মুহাম্মাদ হামদান সাইয়িদ।
১০. বিভিন্ন আরবি-ইংরেজি পত্রিকা ও ম্যাগজিন।
লেখক
আবদুর রহমান আজহারি
শিক্ষার্থী: ইতিহাস বিভাগ, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, মিসর।