সূচনাকাল থেকেই ইসলামকে খ্রিষ্টীয় ইউরোপ বিদ্বেষের চোখে দেখে এসেছে। তারা মুসলমানদেরকে সবসময় শত্রুর নজরে দেখেছে। ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদরা ইসলাম এবং মুসলমানদের উপর বহুমাত্রিক গবেষণা চালিয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কুপ্রবৃত্তিকে প্রাধান্য দিয়েছে, হক জানার পরও মতান্ধতার কারণে গোমরাহ রয়ে গেছে। আর অনেকে গবেষণা করে সত্য জানার পর ইসলাম গ্রহণ করেছেন। ইসলাম নিয়ে তাদের গভীর গবেষণা-পর্যালোচনা শুরু হয়েছে উনিশ শতক থেকে, যখন প্রাচ্য এবং মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছিল এবং পাশ্চাত্য উপনিবেশের নামে প্রাচ্য এবং মুসলিম বিশ্বের উপর তার আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করেছিল।
প্রাচ্যবিদদের ইসলাম নিয়ে গবেষণা শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসলামি তাসাউফ তাদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। কারণ, ইসলামের পুনরুজ্জীবনের পথে তাসাউফের রয়েছে বিশেষ অবদান। ফলত তারা তাসাউফ, উৎস ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে অজস্র লেখালেখি করেছে। পরিচালনা করেছে অসংখ্য গবেষণা কর্ম। তাসাউফের সত্য উদঘাটনে তাদের লক্ষ্য বহুদূর এগিয়ে নিয়েছে। এর উৎস নিয়ে তাদের গবেষণার বিচিত্র ফলাফল এসেছে। হাল্লাজের ঘটনাকে তারা অত্যাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামে হাল্লাজ নির্যাতিত বলে প্রমাণ করতে চেয়েছে। ফলত তাসাউফের ইতিহাস বা ব্যক্তি নিয়ে তাদের লেখাগুলোতে হিংসাত্মক মনোভাবই ফুটে উঠেছে।
উনিশ শতকের শুরু থেকে নিয়ে আজ অবধি পশ্চিমা প্রাচ্যবিদগণ ইসলামী তাসাউফের উৎসের অনুসন্ধান করে আসছেন। প্রাচীন প্রাচ্যবিদগণ এর উৎসের কথা একটি বললেও পরবর্তী প্রাচ্যবিদগণ তাসাউফের একাধিক উৎসের কথা বলেছেন। কিন্তু সকলের ধারণা যে, তাসাউফ ইসলামে অনুপ্রবেশ করেছে। ইসলামের সাথে তাসাউফের কোন সম্পর্ক নেই। কেউ বলছেন, তাসাউফ ইরানি বিশ্বাস বা পারস্যবাসীদের থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। আবার কেউ বলছেন, তাসাউফের উৎস ইসলাম হলেও ভারতীয় বিভিন্ন ধর্ম দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। কেউ বলছেন, তাসাউফের উৎস খ্রিষ্টবাদ এবং ইহুদিবাদ। আবার কেউ এর উৎস ফিরাচ্ছেন প্লেটোবাদের দিকে। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা সেসব মতামতগুলো পর্যালোচনা করব। এবং দেখানোর চেষ্টা করব– ইসলামি তাসাউফের উৎস কোরআন-সুন্নাহ এবং রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম এর পবিত্র জীবন।
‘তাসাউফ’ শব্দের শাব্দিক বিশ্লেষণ:
‘তাসাউফ’ শব্দের মূলধাতু ও সুফি শব্দের নামকরণ নিয়ে বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি মতামত তুলে ধরা হলো:
১. কারো কারো মতে (তাসাউফ) এর মূল ধাতু (আস্-সাফা) অর্থ: পরিছন্নতা,পবিত্রতা। এই মূল ধাতুর ভিত্তিতে যে কোন জিনিসকে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ অপবিত্রতা থেকে পবিত্র করণের নামই হচ্ছে তাসাউফ।
২. কেউ কেউ এ মত পোষণ করেন যে, (তাসাউফ) এর মূল ধাতু হলো (আস্-সাফভূ) যার অর্থ: ভালোবাসায় ও বন্ধুত্বে একনিষ্ঠতা। এ ধাতুর অর্থ হিসেবে সুফি দ্বারা সেই ব্যক্তি উদ্দেশ্য, যিনি সহজে দুনিয়া ও আখেরাতের প্রাপ্য প্রতিদানের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে মাহবুবে হাকিকী তথা আল্লাহর সঙ্গে নিখুঁত ভালোবাসার রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে।
৩. (তাসাউফ) শব্দটি (আস-সাফফু) মূলধাতু থেকে নির্গত বলেও মত পাওয়া যায়। যার অর্থ: কাতার, কারণ সুফিদের অন্তর যেন আল্লাহর দরবারে উপস্থিতির ক্ষেত্রে প্রথম কাতারে।
৪. (তাসাউফ) শব্দটি (আ-সূফফাতু) মূল ধাতু হতে নির্গত বলে কেউ কেউ মত ব্যক্ত করেছেন। আলেমদের একটি দলের মতানুসারে সুফি নামকরণের কারণ হলো সুফিগন গুণাবলীতে আসহাবে সুফফার নিকটবর্তী, যারা রাসুল (স.) এর যুগে ছিলেন ।
৫. এর মূল ধাতু (আস-সুফূ) যার অর্থ পশম। বাবে (তাফাউউল) থেকে -অর্থ দাঁড়ায়: সে পশমের পোশাক পরিধান করল। সাহাবায়ে কেরামের যুগে বিনয় এবং পরমানুগত্য বোঝাতে কোন কোন আহলে হক পশমের পোশাক পরিধান করতেন। তাই তাদের কর্মকে তাসাউফ নামে নামকরণ করা হয়েছে।
আরবি শব্দতত্ত্বের আলোকে শব্দ থেকে নির্গত হওয়ার মতটি অধিক বিশুদ্ধ। যেমন প্রাচ্যবিদ প্রফেসর নিকলসন (১৮৬৮- ১৯৪৫) উক্ত অর্থকে অধিকাংশ আরবি শব্দতত্ত্ববিদদের মত বলে উল্লেখ করেছেন। থিউডর নলডেক (১৮৩৬-১৯৩০) প্রাধান্য দিয়েছেন প্রথম অর্থটিকে। তবে বাকি ব্যাখ্যাগুলোও সুফি চরিত্রের সাথে মিল আছে। ইমাম আবুল কাসেম আল- কুশাইরী বলেন, ‘সুফি উক্ত শব্দটি শাব্দিক বিশ্লেষণের ঊর্ধ্বে’। এটা উক্ত পরিভাষার উপাধি মাত্র। অর্থাৎ ইসলামি পরিভাষায় সুফিগণ এমনভাবে পরিচিত যে তাদেরকে শাব্দিক বিশ্লেষণ দিয়ে মূল্যায়নের প্রয়োজন নেই। ইবনে খালদুনও (১৩৩২-১৪০৬) উক্ত মত গ্রহণ করেছেন। (৪) আল বিরুনির (৯৭৩-১০৪৮ হি.) বিশ্লেষণ মতে সুফি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে গ্রিক শব্দ সপ(Soph) থেকে, যার অর্থ হিকমত বা দর্শন। দার্শনিককে ফিলোসোফার (philosopher) বলা হয়। ফিলা (phila) অর্থ প্রেমিক। ফিলোসফার অর্থ দর্শনমনস্ক বা বিজ্ঞানপ্রিয় ব্যক্তি। এটা পরিবর্তিত হয়ে আরবি ভাষায় সুফ (আরবি ‘ছোয়াদ’ বর্ণ যোগে) ব্যবহার হচ্ছে। গ্রিকদের একটি পণ্ডিত শ্রেণী ছিলেন, যারা বিশ্বাস করতেন যে, চিরস্থায়িত্ব একমাত্র প্রথমজনের। তিনি অন্য সবকিছুর থেকে অমুখাপেক্ষী, বাকি সব কিছুই তাঁর মুখাপেক্ষী। মুসলমানদের মধ্যে যাদের বিশ্বাস এমনতর তাদেরকে সুফি বলা হয়। আলবিরুনির বিশ্লেষণ বাহ্যিক ভাবে যৌক্তিক মনে হলেও বাস্তবতা এর বিপরীত। কারণ, গ্রিকদের গ্রন্থাবলি আরবিতে অনুবাদের সূচনা হয়েছে তৃতীয় হিজরী শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। অথচ তাসাউফ ও সুফি শব্দের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশ ঘটেছে হিজরি ২য় শতাব্দিতে।
পারিভাষিক অর্থ:
(তাসাউফ) এর পারিভাষিক অর্থ নিয়ে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতপার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
১. জাকারিয়া আল আনসারি রহ. বলেন:
‘তাসাউফ এমন একটি বিদ্যা যার দ্বারা আত্মশুদ্ধি, চারিত্রিক স্বচ্ছতা এবং নিজের ভেতর বাহির বিনির্মাণের অবস্থা জানা যায়।’
২. জুনায়েদ বাগদাদী রহ . ( ২১৫- ২৯৮হিঃ) বলেন: ‘তাসাউফ বলা হয় সকল ভাল গুণাবলি গ্রহণ করা এবং সকল মন্দ গুণাবলি পরিহার করাকে।’
৩. আহমাদ ইবনে আজীবাহ রহ.(১৭৫৭-১৮০৮) বলেন: ‘তাসাউফ ঐ জ্ঞান কে বলা হয় যার দ্বারা রাজাধিরাজ আল্লাহ তা’আলা পর্যন্ত পৌঁছা যায়, অন্তরকে পঙ্কিলতা মুক্ত করা যায়, এবং বিভিন্ন গুণাবলী দ্বারা নিজের অন্তরকে সজ্জিত করা যায়,যার শুরুতে রয়েছে জ্ঞান মধ্যখানে আমল এবং শেষে আছে প্রাপ্তি।’
৪. আবুল হাসান শাজেলী রহ. বলেন: ‘তাসাউফ হলো আত্মাকে আল্লাহর দাসত্বের প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং প্রভুর বিধান পালনে অভ্যস্ত করানো।’
তাসাউফের সকল সংজ্ঞা থেকে যেসব বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় তার সবগুলোই হচ্ছে উত্তম চরিত্র এবং উন্নত ও মানবিক গুণাবলি। প্রায় সংজ্ঞাতেই স্পষ্ট ভাবে উন্নত চরিত্রের কথা বলা হয়েছে। কেননা তাসাউফের মূল উৎস ও ভিত্তি হলো কোরআন ও হাদিস। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শের প্রত্যেকটি দিক নিষ্ঠার সাথে গ্রহণ করা এবং তার আখলাকের আলোকে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি এবং তাকে পাওয়ার সাধনা, তার অস্তিত্বকে উপলদ্ধির চেষ্টা এবং তার দিদার লাভের চেষ্টাই তরিকত বা তাসাউফের উদ্দেশ্য।
স্রষ্টা আর সৃষ্টি উভয়ের সন্তুষ্টি বিধান করার নাম ও তাসাউফ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী উপাধির সাথে উক্ত দু’টি বিষয় জড়িত। এ ব্যাপারে আল-কোরআনে একটি আয়াত বর্ণিত হয়েছে এর অর্থ হলো, ‘নিশ্চয় আপনি উত্তম চরিত্রে অধিষ্ঠিত আছেন।’ (আল-কলম আয়াত, ৪)
এ আয়াতে উত্তম চরিত্রের একটি ব্যাখ্যা হল সম্পর্ক ছিন্নকারীর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা, অত্যাচারীকে ক্ষমা করা এবং অসদাচরণকারীর প্রতি সদাচরণ করা। আরেকটি ব্যাখ্যা হল, এমন আচরণ করা যাতে আল্লাহ তাআলা এবং সৃষ্টিজগতের সকলেই রাজি থাকে।
তাসাউফের উৎসমূল নিয়ে বিতর্ক :
ইসলামি তাসাউফের উৎস ইরানি আধ্যাত্মবাদ:
জার্মান প্রাচ্যবিদ এফ এ ডি থুলুক তার রচিত Sufism Sire the Ologia Panthistiea গ্রন্থে লেখেন, ইসলামী তাসাউফের উৎস ইরানি আধ্যাত্মবাদ। একই মতের প্রবক্তা প্রফেসর এডওয়ার্ড গ্র্যান্ড বিল ব্রাউন (১৮৬২-১৯২৬)। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা এপ্রিল ২০১৯ )
তিনি তার মতের পক্ষে যুক্তি পেশ করে বলেন, উত্তর ইরানে ইসলামি বিজয়ের পর অধিকাংশ অগ্নিপূজক তাদের ধর্মের উপর রয়ে যায়। আর তাসাউফের বড় বড় মনীষীরা প্রায় ইরানের খোরাসান থেকেই বেরিয়ে এসেছেন। এছাড়াও তাসাউফের ভিত্তি যাদের উপর তারা অধিকাংশই ছিলেন অগ্নিপূজকদের উত্তরসূরী যেমন: বায়েজিদ বোস্তামি (৮০৪-৮৭৪খ্রি.), মারুফ কারখি (৭৫০-৮১৫খ্রি.) প্রমুখ। এছাড়াও প্রাচ্যবিদ ডোজি (Dozy) ১৮২০-১৮৮৩খ্রি.) তার লিখিত বইয়ে উল্লেখ করেছেন, তাসাউফ মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে ইরান থেকে। ইরানে এসেছিল হিন্দুস্থান থেকে। তার মতে ইরানে দীর্ঘদিন যাবত একটি দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণা প্রচলিত ছিল। তাহলো, সবকিছুর মূল উৎস হলেন আল্লাহ তাআলা। বস্তুর নিজস্ব কোন অস্তিত্ব নেই। আর প্রকৃত অস্তিত্ব একমাত্র আল্লাহ তায়ালার। এই জাতীয় কথা ইসলামী তাসাউফের মূল বক্তব্য হিসেবে উচ্চারিত হয়।
এর উত্তরে আমরা বলতে পারি— তাসাউফ মারুফ কারখি আর বায়েজীদ বোস্তামি রহ.দের উপর নির্ভরশীল বা দায়বদ্ধ নয়। আর না তাসাউফ একমাত্র তাদের মাধ্যমেই বিস্তার লাভ করেছে। বরং এতে মরক্কো ও মিশরের সুফিদের বিশেষ দখল রয়েছে। যেমন জুন্নুন মিসরি (৭৯৬-৮৫৯খ্রি.), আবু সুলাইমান দারানি (১৪০-২১৫হি.), হারেস মুহাসিবি (৭৮৬-৮৫৭খ্রি.) রহ. প্রমুখ। আর বেশিরভাগ সূফি পারস্যের মানুষ ছিলেন তার মানে এই নয় যে, সূফিবাদ পারস্য হতে এসেছে। কারণ, আবু বকর ইবনুল আরাবি ও ইবনুল ফরিদ সহ অনেক দার্শনিক আরবি ভাষাভাষি ছিলেন। আর আমাদের প্রিয়নবী, সাহাবীগণ ও তাবিঈগণের সময় হতে এক ধরনের তাপস্যা শুরু হয় এবং তারা বিদেশী ধ্যান-ধারনা ও প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলেন।
দ্বিতীয়ত: যাদের দৃষ্টিভঙ্গি এটা যে, পৃথিবীর কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। প্রকৃত অস্তিত্ব শুধুই আল্লাহ্ তায়ালার সত্তার। যদি একথা দ্বারা ‘ওয়াহদাতুল ওজুদ’ বা সর্বেশ্বরবাদ (pantheism) উদ্দেশ্য হয়, তাহলে বলবো এই দৃষ্টিভঙ্গির উৎপত্তি হয়েছে ষষ্ঠ শতাব্দীতে। এর পূর্বে সুফিদের দৃষ্টিভঙ্গি এরকম ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। প্রাচ্যবিদ আরবেরি (A J Arberry ১৯০৫-১৯৬৯) tholuk এর দৃষ্টিভঙ্গি খণ্ডন করতে গিয়ে বলেন : এটা আধুনিক বিশ্লেষণ নীতির পরিপন্থি। এবং বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছুই নয়।
আবার থলুক নিজেই লেখেন যে, তাসাউফ মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রুহানি জিন্দেগি বা আধ্যাত্মিক জীবনের সারাংশ বিশেষ। অন্যদিকে প্রাচ্যবিদ নিকলসন লেখেন, ইলমুল কালাম, ফিকহ্ এবং তাসাউফের প্রথম ও প্রধান ভিত্তি হলো কোরআন ও সুন্নাহ। এছাড়া আরবরা ইরানিদের থেকে সর্বদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল। ইরানিদের কাছে এমন কিছু ছিল না যা তারা আরবদেরকে দিবে। বিশেষত ইসলাম আগমনের পর কুরআন-সুন্নাহর শক্তিতে আরবরা ইরানিদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। তারাই ইরানিদের উপর সাংস্কৃতিক ও ভৌগোলিক বিজয় অর্জন করে, তাদের মধ্যে আদর্শিক বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। অতএব, তাসাউফের উৎস ইরানি আধ্যাত্মবাদ বক্তব্যটির সাথে কোন ভাবেই একমত হওয়া যায় না। তবে ইসলামের বিজয়ের ফলে ব্যাপকভাবে ইরানিরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। এতে করে তাদের প্রাচীন চিন্তা-বিশ্বাস ইসলামি বিশ্বাসের সাথে মিশে যায়। এভাবে কিছু বিশ্বাস ঢুকে গেলেও সেটা আকারে তেমন বড় না। এবং সেটা একান্ত দ্বিতীয় স্তরের বিষয়। বরং এখানে সঠিক পন্থা হলো ইসলামি তাসাউফের বিষয়গুলো ইরানি আধ্যাত্মবাদে খুঁজে বের করা।
দ্বিতীয় বিতর্ক: ইসলামী তাসাউফের উৎস গ্রিক আধ্যাত্মবাদ
একদল প্রাচ্যবিদের দাবি— ‘ইসলামি তাসাউফ গ্রীক আধ্যাত্মবাদের একটি বিশেষ প্রকারের নাম।’ ইসলামি তাসাউফের কিছু কিছু চিন্তাধারা নব্য ও প্রাচীন প্লেটোবাদের সাথে সাদৃশ্য রাখে। যেমন: ই এইচ হোয়াইনফিল্ডের (১৮৩৬-১৯২২ খ্রিঃ) দাবি: বাতেনি ফালসাফা ও তাসাউফের ইলহাম ও কাশফের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক মিল রয়েছে। যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সুফিগণ নব্য প্লেটোবাদ দ্বারা প্রভাবিত।
মিশরের তাসাউফের বড় বড় ওলামা-মনীষী যেমন, আবুল আলা আফিফি, ডক্টর মোহাম্মদ মোস্তফা হুলমি এবং আবুল ওয়াফা তাফতাযানি রহ. একথার উপর একমত পোষণ করেছেন যে, ইসলামী তাসাউফের কিছু পরিভাষা গ্রীক দর্শন থেকে ব্যাপকভাবে এবং প্লেটোর দর্শন থেকে বিশেষভাবে অনুবাদের মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছে। যা ইবনে নায়েম ‘অথোলোজিয়া অ্যারিস্টটল’ গ্রন্থের অনুবাদের মাধ্যমে মুসলমানদের সামনে পেশ করেছিল যেগুলো এরিস্টটল প্লেটোর বাণী থেকে নিয়েছিল। এর ভিত্তিতেই লাহুতি মাযহাবের জন্ম হয়েছিল।
ড. মোস্তফা হুলমি লিখেন– নব্য প্লেটোবাদ সম্পর্কিত গ্রন্থ ‘অথোলজিয়া অ্যারিস্টটলয়’ এ উল্লেখ আছে, উর্ধ্ব জগতের বাস্তবতা চিন্তাফিকির দিয়ে উপলদ্ধি করা সম্ভব নয়। বরং তা আত্মা ও দৃশ্যমান জগত থেকে আলাদা হয়ে প্রত্যক্ষ করা যায়। এজাতীয় দৃষ্টিভঙ্গি দার্শনিক সূফিদের কথায়ও পাওয়া যায়। তাদের বক্তব্য, অনুভূতি ও আকল দিয়ে ‘হাকীকি মারিফাত’ বা মূল তত্ত্ব উদঘাটন সম্ভব নয়। তা একমাত্র তখনই সম্ভব যখন বান্দা নফসকে ছেড়ে দিবে। এবং আল্লাহ তায়ালা তার অন্তরে নূর ঢেলে দিবেন, সে প্রভুর সত্তার মধ্যে নিজেকে এমনভাবে বিলীন করে দিবে যে, দুই সত্তার মধ্যে কোন পার্থক্য থাকবে না। এতে বোঝা যাচ্ছে, মারেফাত অর্জনের ক্ষেত্রে ইসলামি তাসাউফ ও গ্রীক আধ্যাত্মবাদের সাদৃশ্য বিদ্যমান।
এমনিভাবে ‘ডলফ টেম্পল’ এর মধ্যে লেখা আছে, ‘নিজেকে চিনে নাও’ কথাটিকে মুসলিম সূফিগণ নবী মুহাম্মদ সা. এর দিকে সম্পর্কিত কথাগুলোর অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ‘যে ব্যক্তি নিজেকে চিনল, সে তাঁর প্রভুকে চিনল।’
একইভাবে আধ্যাত্মবাদী দার্শনিকদের তৈরিকৃত পরিভাষা যেমন; কালেমা, আকলে আওয়াল, ইল্লত- মালুল, ফয়জে ভিজদ, ওয়াহদত, এবং কাসরত জাতীয় শব্দসমূহের ব্যবহার ইসলামী তাসাউফের গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ।
আমরা একথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করছি না যে, সুফিদের কেউ কেউ নিউ প্লেটোনিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিল না, তবে ইসলামি তাসাউফের মধ্যে এই প্রভাব কয়েকটি স্তর পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল যা আকলে ফা’আল (সক্রিয় জ্ঞান) এবং নফসকে শরীর থেকে আলাদা করে উপরে সৃষ্টির সাথে মিলন ইত্যাদি জাতীয় কথাবার্তা যারা বলত, এজাতীয় প্রভাব শুধু তাদের উপরই ছিল। এছাড়া যারা মারেফাতের কথা বলেছেন তাদের প্রকৃত উৎস ছিল সঠিক ইসলামি উৎস। যার নমুনা কোরআন হাদিসে পাওয়া যায়।
আর দ্বিতীয় কথা হল যাদের তাসাউফে এই জাতীয় প্রভাব বিদ্যমান ছিল তারা হলেন হিজরি ৬ষ্ঠ শতাব্দীর লোক। এর আগে তাসাউফ তার প্রকৃত ইসলামি রঙ্গে মজবুত ভিত্তির উপর কায়েম ছিল।
প্লটিনাস বলেন: জগতের সবকিছুই শ্বাশ্বত, চিরঅক্ষয়, অব্যয়। কেননা তা গঠিত স্থায়ী ফর্ম (আকৃতি) ও মেটার (পদার্থ) দ্বারা। এখানে সাফল্যের কাজ হচ্ছে মাত্র তিনটি- সঙ্গীত বা শিল্পকলা, প্রেম ও দার্শনিকতা। এর কোন দিকটি ইসলামের অনুরূপ? সৃষ্টিজগতকে চিরঅক্ষয় মানলে তো মুসলমানই থাকা যাবে না। জীবনবোধ, স্রষ্টাচিন্তা, আধ্যাত্মভাবনা, জগতদর্শন, খোদাপ্রাপ্তির পথ, কর্ম ও রূপরেখা- এগুলোর সমন্বয়েই তো তৈরি হয় আধ্যাত্মিক মতবাদ। কিন্তু নিউ প্লেটোবাদ প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতিকূল। তাসাউফের সাথে এর দূরত্ব ব্যাপক। তাহলে তার দ্বারা তাসাউফ প্রভাবিত বা তা তাসাউফের উৎস হলো কোথায়? কীভাবে?
তৃতীয় বিতর্ক: ইসলামি তাসাউফের উৎস ভারতীয় সংস্কৃতি
প্রাচ্যবিদদের কতকের অভিমত, ইসলামি তাসাউফের উৎস ভারতীয় সংস্কৃতি। যা ভারতীয় অন্যান্য রীতিনীতির মতই ইসলামে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা ইসলামি তাসাউফের কিছু কিছু দৃষ্টিভঙ্গি ও আমলি ওজিফাকে ভারতীয় আধ্যাত্মবাদের সাথে সাদৃশ্য দেখায়। যেমন ভারতীয় আধ্যাত্মবাদে সংযম সাধনা, জিকির ও ফিকরের পদ্ধতি, মারেফাতে ফানা এবং ‘ওয়াহদাতুল উজুদ’ জাতীয় মাসআলায় এক ধরনের সামঞ্জস্য রয়েছে। ভন ক্রেমার, ডোজি, ই এইচ পলমার, ম্যাক্স হরটন, হর্টম্যান, আর সি যায়েনহার প্রমুখ উক্ত মতের প্রবক্তা। এ ব্যাপারে হরটনের অভিমত হলো: ইসলামি তাসাউফের মৌলিক নীতিমালা ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ থেকে গৃহীত। এর জবাবে ডক্টর আবুল আলা আফিফি লেখেন, হরটন তার মত প্রমাণ করার জন্য পেশী শক্তির আশ্রয় নিয়েছেন। এ বিষয়ে পর্যায়ক্রমে তিনি ১৯২৭ ও ১৯২৮ সালে দুটি প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, বায়েজিদ বোস্তামি, মনসুর হাল্লাজ, জুনায়েদ বাগদাদিদের তাসাউফে ভারতীয় চিন্তা ধারার সমাহার ছিল ব্যাপক আকারে। বিশেষ করে মনসুর হাল্লাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে ভারতীয় চিন্তা দর্শনের প্রভাব বেশি ছিল। এর সাথে কিছু ফারসি পরিভাষা বিশ্লেষণ করার পর তিনি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ইসলামি তাসাউফ হুবহু বৈদিক মতাদর্শ বা বেদান্ত দর্শন। এই মতকে সাব্যস্ত করার জন্য যেসকল যুক্তি পেশ করেন তা হলো :
১. ইসলামের প্রাথমিক যুগের অধিকাংশ তাসাউফের মাশায়েখগণ ছিলেন অনারবি যেমন: ইব্রাহিম বিন আদহাম (৭১৮-৭৮২খ্রি.), শাকিক বলখি, বাইজিদ বোস্তামি এবং ইয়াহিয়া বিন মুয়াজ রাযি (৮৩০-৮৭২ খ্রি.)।
২. ইসলামি তাসাউফ সর্বপ্রথম খোরাসানে প্রকাশ পেয়েছে এবং সেখান থেকেই বিস্তার লাভ করেছে।
৩. তুর্কিস্তান ইসলামি বিজয়ের পূর্বে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দুনিয়ার দীনি ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল। এর বাসিন্দারা ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামি তাসাউফকে নিজেদের প্রাচীন সংস্কৃতির রঙে রাঙ্গিয়ে নিয়েছিল।
৪. মুসলমানগন নিজেরাও ইসলামি তাসাউফে ভারতীয় রীতিনীতির মিশ্রণের কথা স্বীকার করেছেন।
এছাড়া এ জে আরবেরি রিচার্ড হরটনের উক্তি উদ্ধৃত করে তিনি বলেন– বায়েজিদ বোস্তামির ওস্তাদ ছিলেন সুফি আবু আলী সিন্ধি। এতে স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, তাসাউফের আসল উৎস ভারতীয় আধ্যাত্মবাদ। আলফ্রেড ভন ক্রেমার রায় দেন– তাসাউফে মৌলিকভাবে দুটি জিনিস পাওয়া যায়। এক: খৃস্টধর্মের বৈরাগ্যবাদ দুই: ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম যা জুন্নুন মিশরি, হারেস আল মুহাসিবিদের মধ্যেও পাওয়া যায়।
এ সংশয় ও বিতর্কের জবাবে আমরা বলতে চাই— তাসাউফ কীভাবে হুবহু বেদান্ত মতবাদ হয়? বৌদ্ধদের ‘নির্বাণ’ ও তাসাউফের ‘ফানার’ সাদৃশ্য দিয়ে প্রমাণ করা অসম্ভব। নির্বাণ আগাগোড়া নেতিবাদী। ফানা আগাগোড়া ইতিবাচক। ফানা সুফিদের আধ্যাত্মিক ঊর্ধ্বগতির শেষ স্তর নয়। চিরন্তন সত্যে জাগরণ তাদের পরবর্তী কামনা। বৌদ্ধদের নির্বাণ আত্মবিলাপেই শেষ। পরবর্তী কোন স্তর নেই। নির্বাণ মানুষের প্রকৃতি বিরোধী পথ দিয়ে হাটে। প্রকৃতির বিনাশ কামনা করে। ফানা মানবপ্রকৃতির ইতিবাচক বিকাশের পথে হাঁটে। তার মহোত্তম উদ্ভাস কামনা করে। নির্বাণ লালন করে না চিরন্তন সত্তার প্রেম। ফানা হচ্ছে চিরন্তন সত্য প্রেম প্রেম আর প্রেম। একইভাবে ভারতীয় ভাবধারা থেকে তার উৎপত্তি কীভাবে হবে? যোগী-ঋষীবাদ তো নিরেট শিরিক। ইসলাম তো এর বিনাশ নিশ্চিত করতে চায়। তাসাউফ তো তার নিরাপোষ অধ্যায়। বৌদ্ধমতবাদ তো ইসলামি জীবনদর্শনের বিপরীত। সেখানে কু এবং সু দুই দ্বন্দ্বমুখর পরাক্রমশালী শক্তি। কিন্তু তাসাউফ দেখে জড় ও আধ্যাত্মিক জগতে একেরই বিবর্তন। ভিক্ষুরা তো মোক্ষ লাভে প্রত্যাখ্যান করে সব স্বাভাবিকতা। তাসাউফ স্বাভাবিক জীবনে সাধনার উচ্চস্তরে আরোহণ করতে বলে। বৌদ্ধমতবাদ তো খোদাকেই চিনে না, চিনায় না, চিনাতে চায়ও না। মোক্ষ ও মুক্তির কথা বলে। কিন্তু খোদাহীন মোক্ষ ও মুক্তির বায়বীয় ধারণাকে প্রথমেই নস্যাৎ করতে চায় তাসাউফ। (অসম্পূর্ণ)
(দ্বিতীয় পর্বসহ সম্পূর্ণ লেখাটি পড়ুন ‘আল আযহার ব্লগে’। ভিজিট করুন: blog.awsbe.org)
তথ্যসূত্র:
১- তাসাউফের আসল রূপ পৃঃ ৬৬,৬৭,৬৮
২-Nicholson, R A, mystism of Islam, (London: Routledge, kegan Paul, 1914)p. 3
৩- আল-কুশাইরি , আবুল কাসেম আব্দুল করিম, আর-রিসালাতুল কুশাইরিয়্যা, তা. বি, পৃ. ২৩৯
৪- ইবনে খালদুন, আব্দুর রহমান বিন মুহাম্মদ আল-হাদরামি , তারিখ, আল মাকতাবা আশ- শামিলা তা. বি, ১/৪৬৭
৫- করম শাহ আজহারি, জাস্টিস মুহাম্মদ, মুকাদ্দামা কাশফুল মাহযুব (উর্দু), (লাহোর: জিয়াউল কুরআন পাবলিকেশন্স, ২০১০)পৃ. ৯
৬- معراج التشوف إلى حقائق الصوف, আহমাদ বিন মোহাম্মদ বিন আজিবা আল-হাসানী, পৃঃ৪
৭- সকর, হামিদ ,। নুর- আল তাহকীক, পৃ:৯৩
৮- مقدمة في التصوف الإسلامي, লাজনাতুত তালিফ ওয়ান নাশর, কায়রো।
৯- المدخل إلى علم التصوف، পৃঃ২৬
১০- Arberry, An introduction to the history of sufism,p-3
১১- أبحاث في التصوف على المنقذ من الضلال للغزالي، ড. আব্দুল হালিম মাহমুদ- ৯৫
১২- R.A.Nichalson, The idea of personality in sufism, pp- 8-9, lahore 1964
১৩- الحياة الروحية في الاسلام, ড.মোস্তফা হুলমী-৪২
১৪- E.H.Whinfield, Gulshan-i-Raz,London, 1980, pp- VI, VII
১৫- الحياة الروحية في الاسلام, ড.মোস্তফা হুলমী- ৫৭-৫৮
১৬- প্রাগুক্ত -৬১
১৭- প্রাচ্যবিদদের দাঁতের দাগ, মুসা আল হাফিজ-১৫৩
১৮- مدخل إلى التصوف الإسلامي, ড.আবুল ওয়াফা তাফতাযানী, পৃ-২৮
১৯- مقدمة في التصوف الإسلامي, ড.আবুল আলা আফিফী, পৃ-ح
২০- প্রাগুক্ত- ط
২১- Arberry, An introduction to the history of sufism,p-34
২২- فصول في التصوف, ড. হাসান শাফেয়ী -১০
লেখক: শিক্ষার্থী, ফ্যাকাল্টি অব এডুকেশন, আল আযহার ইউনিভার্সিটি, মিশর।