‘হে ইহুদি সন্তানেরা! জাগো, এইতো সময় জেগে ওঠার!’
—বিশ্ব ইহুদিদের প্রতি এভাবেই জাগরণের আওয়াজ তোলে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।
কালের অনিরুদ্ধ ধারায় বিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রেরণা কিছু বিবেককে মানববিধ্বংসী করে তোলে। তাদের রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের বিলাসী মনোবৃত্তি সমৃদ্ধ জনপদের শান্তিকামী মানুষের জীবন দুঃসহ করে দেয় ও দীর্ঘ মেয়াদী রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও ধারাবাহিক বিশ্বযুদ্ধের রক্তাক্ত উপাখ্যান তৈরি করে। সর্বকালের সবচে ভয়ঙ্কর বার্তা নিয়ে আসা ঊনবিংশ শতাব্দী অকল্পনীয় সব আধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্করের সাথে সাথে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যও জন্ম দিয়েছে। যেগুলো শতাব্দীর উন্নত অর্জনগুলোকে ম্লান করে পৃথিবীব্যাপী জাতিগত বিদ্বেষের অনল জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেগুলো হলো—
১. জাতীয়তাবাদ: ফরাসি বিপ্লবের পর এই চেতনার সর্বাত্মক বিকাশ ঘটে এবং প্রতিটি জাতি আপন শিকড় সন্ধানে মশগুল হয়ে পড়ে। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি জাতিসত্ত্বা নিজেদের অধিকার ও আইডেন্টেটির খোঁজে শুরু করে তোড়জোড়।
২. ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর মাঝে এশিয়া আফ্রিকায় উপনিবেশ, দখল ও পারস্পরিক শক্তি প্রদর্শনে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা:
এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দানে তিনটি রাষ্ট্র প্রাধান্য বজায় রেখে অগ্রসর হচ্ছিলো। বৃটিশ, ফরাসী ও রুশ। তারা নিজেদের সেনাদল, নৌবহর, বাণিজ্য কোম্পানিসমূহ ও খ্রিস্টান মিশনারি সংস্থাগুলোকে নিয়ে এশিয়া আফ্রিকা ও অন্যান্য মহাদেশগুলোতে অভিযান চালাতে লাগলো। এই অভিযানগুলোতে উপনিবেশিত অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসীদের হত্যা, তাদের মালামাল লুণ্ঠনসহ মানববিধ্বংসী সমস্ত কাজ অনায়াসে করে যেতে লাগলো। আর এই সমস্ত গর্হিত কাজগুলোকে গৃহীত করার জন্য সাজাতে লাগলো রকমারি দার্শনিক তত্ত্ব।
৩. প্রাচ্যবিষয়ক সমাধান নীতি :
এই নীতির প্রধান অঙ্গীকার ছিলো, উসমানীয় মুসলিম সাম্রাজ্য ভেঙে প্রাচ্যের ভূমিকে নিজেদের মাঝে বণ্টন করে নেওয়া। তৎকালীন উসমানী সাম্রাজ্য ছিলো তিন মহাদেশের বিশাল বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে। কস্পিয়ান সাগরের উপকূল থেকে আটলান্টিকের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমির বক্ষস্থলে তার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ছিলো। কিন্তু তখনো সাম্রাজ্যবাদীদের মাঝে পারস্পরিক ঐক্য না থাকায় উসমানীয় সাম্রাজ্যের (ইউরোপ কতৃক প্রদত্ত অভিধা রুগ্ন মানব) আনুষ্ঠানিক পতন বিলম্ব হচ্ছিলো। তাছাড়া ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দও চাচ্ছিলো নিজেদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে গুছিয়ে নেবার আগ পর্যন্ত সেই রগ্ন মানবের মৃত্যু বিলম্বিত করা। তারপর নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে তারা উসমানীয় সাম্রাজ্যের মৃত্যু ঘোষণা করে নিজেদের মধ্যে এর উত্তারাধিকারী হিসসা বণ্টন করে নিয়ে নেয়।
৪. ইহুদিবাদ ও জয়োনিস্ট আন্দোলন :
এটি এমন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী, যারা হাজার হাজার বছর ধরে স্রষ্টার অভিশাপের বোঝা বয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন শরণার্থীর লাঞ্ছনা বয়ে বেড়াচ্ছিলো। অসাধুতা ও অসভ্যতার জন্য তারা প্রায়ই শত্রুর শ্যেন লক্ষ্যস্থল পরিণত হতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশ্বে প্রায় বারো মিলিয়ন ইহুদীর মধ্যে নব্বই শতাংশই বাস করতো রাশিয়া থেকে পূর্ব ইউরোপের পোল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে। এই সময় মাঝে মধ্যেই তারা খৃষ্টানদের দ্বারা Pogrom নামক এক আনুষ্ঠানিক সুসংবদ্ধ গণহত্যার শিকার হতো। সেসময় ইউরোপের কৌশলগত চিন্তা ছিল কীভাবে বিপরীতমুখী এই চারটি উপাদান কে একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত করা যায় এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের মাধ্যমে এগুলোর সুদৃঢ় বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট শক্তিগুলোর স্বার্থ চরিতার্থ করা যায়। সেই লক্ষ্যে বিশ্ব ইতিহাসের এক কিংবদন্তি রাজনীতিক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট এই চারটি উপাদান—জাতীয়তাবাদ, প্রাচ্যবিষয়ক নীতি, উপনিবেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ইহুদিবাদের মধ্যে সেতুবন্ধন গড়ে তোলার প্রয়াস পায়। অভিন্ন রাজনৈতিক কৌশলে এ সবগুলোকে একত্রে কাজে লাগাতে চেয়েছিলো। এক্ষেত্রে সে শেষ প্রতিপাদ্য ইহুদিবাদকেই প্রাধান্য দেয়। এক পর্যায়ে এই কল্প-কাহিনীর বাস্তবায়নে কিংবদন্তি নেপোলিয়ন আহ্বান করে– হে বিশ্বের ইহুদিরা জাগো! এই তো সময় জেগে ওঠার!
এই আহ্বানের অন্তরালের ইতিহাস আরো গভীর, আরো সূক্ষ্ম। কেননা কিংবদন্তির আহ্বান লুকিয়ে থাকে প্রচ্ছন্ন অভিলাষের কোলে। নেপোলিয়নের গোপন অভিলাষ ছিলো, ইউরোপে ইহুদি অভিবাসী ঢেউ থামিয়ে দেওয়া এবং ইউরোপের ভবিষ্যতকে ইহুদি আবাস মুক্ত করা। এই ইহুদি আপদকে সে প্রাচ্যের মূল কেন্দ্রে (ফিলিস্তিন) স্থাপন করে চিরকালের জন্য প্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করা ও প্রাচ্যের উপর পশ্চিমা আধিপত্য বিস্তার করে পরাজিত ক্রুসেডের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলো।
তার সাজানো নকশায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই বেলফোর চুক্তির মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে ইহুদিদের ভূমি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের ইহুদি অভিবাসী ঢেউ ফিলিস্তিনের বুকে আছড়ে পড়তে শুরু করে। তাদের এমন জঘণ্য কর্মে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যখন শান্তিকামী মানুষের প্রতিবাদের ঝড় উঠলো, তখন তারা একে বৈধতা দেওয়ার জন্য তথাকথিত ও বিকৃত ধর্মীয় ফেনোমেনো হাজির করলো। সাথে তত্ত্বীয় বয়ানও প্রতিষ্ঠা করলো।
এটা করতে গিয়ে তারা এতটাই বেশামাল, বেপরোয়া ও বিবেকহীনতার পরিচয় দিলো যে, ঈসা (আঃ) তথা যিশুর পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসা প্রসিদ্ধ ধর্মীয় বিশ্বাসকেও পাল্টে দিলো। এর একটা জ্বলন্ত উদাহরণ হল,বিশ্ব নেতৃত্বের চালিকাশক্তি জায়নবাদীদের হাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত উনিশ শতক পর্যন্ত খ্রিস্টানদের বিশ্বাস ছিল, পৃথিবীতে একমাত্র এন্টি-ক্রাইস্ট হলো ইহুদিরা। যখনই ক্ষমতার পালাবদল ইহুদিদের দিকে মোড় নিলো তখনই তারা তাদের বিশ্বাস বদলে প্রলাপ বকতে শুরু করলো, মুসলিমরা হলো এন্টি- ক্রাইস্ট। তাদের মিডিয়া, বইপুস্তক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাট্যে, চলচ্চিত্র সর্বত্রে একই বার্তা ‘মুসলিমরা যিশু বিরোধী’। এর কিছু প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেয়া যাক। ওয়েবার ও হাস্টিংস তাদের যৌথ গ্রন্থ Is this the Last Century তে স্পষ্ট ঘোষণা করেছে, আরবরাই হলো এন্টি-ক্রাইস্ট। আমেরিকান প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ Paul Samuel Boyer তাঁর বহুল প্রচলিত গ্রন্থ When Time Shall Be No More বইতে কোন অস্পষ্টতা না রেখেই লিখে দিলো— আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ও কুটিল নানামুখী গোত্রগুলো ঈশ্বরের ঘোষিত শত্রু গগ-মেগগ তথা ইজুজ মাজুরের সহযোগী হবে। তাই ডিভাইন কমান্ডের ন্যায্য ও অনিবার্য দাবি হলো, আরবদের শুধু জেরুজালেম থেকেই নয় বরং গোটা মধ্যপ্রাচ্য থেকে নির্মূল করতে হবে।
প্রখ্যাত মার্কিন ধর্মীয় গুরু জেরি ফলওয়েল ইসরাইলকে সমর্থন করা ও নির্বিবাদে সহযোগিতা করা প্রতিটি খৃস্টানের ধর্মীয় বিশ্বাস হিসেবে স্থির করে দিল। সাথে সতর্কবাণীও বিবৃত করল যদি আমরা ইসরায়েলকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হই তাহলে ঈশ্বরের কাছে আমরা গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবো। শুধু তাই নয় বরং আমেরিকার অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যাবে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তার ধর্মবোধের তৃপ্তির উদগীরণ তুলে বলেন, ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অর্থ হলো, হাজার বছর পূর্বে বাস্তুচ্যুত ইহুদিদের পুনরায় প্রত্যাবর্তনের বাইবেলীয় ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তবায়ন। সাবেক মার্কিন সিনেটর মার্ক হ্যাটফিল্ড নিজের বিশ্বাসের কথা জানিয়ে ঘোষণা করলো— পবিত্র ভূমিতে ইহুদিদের প্রত্যাবর্তন যিশুর আগমন পূর্বক স্বর্গীয় বিশ্ব নির্মাণের নিদর্শন হিসেবে আমি বিশ্বাস করি। ১৯৯৮ সালের ২৭ ডিসেম্বর The New York Times লিখেছে, রেভারেন্ড ক্লাইভ লটের মতে, যিশুর দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে আগমনের পূর্বে অবশ্যই তৃতীয় ইহুদী উপাসনালয় নির্মাণ করতে হবে। আর এজন্য বায়তুল মাকদিস ভেঙ্গে ফেলার বিকল্প নেই। আজকের বাস্তবতায় ইহুদী জয়োনিস্টদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বহু অইহুদী জায়োনিস্ট। Regina S. Sarif তাঁর বিখ্যাত বই Non-Jewish Zionism: Its Roots in Western History তে ইহুদী, অ-ইহুদী জায়োনিস্টদের বিধ্বংসী বহু কর্মযজ্ঞ ও তাদের দোসরদের সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করেছেন।
আসলে কথা হচ্ছে, তাদের ফিলিস্তিন চাই, হোক না তা মুসলিমদের লাশের স্তুপের ভিত্তি করে।
আজ এত বছরর যাবত ফিলিস্তিনে জয়োনিস্টদের দখলদারিত্ব ও হত্যাযঞ্জ চলছে পশ্চিমাদের প্রাকাশ্য মদদে, পাশাপাশি মুসলিম-বিশ্বের ক্ষমতার সিংহাসনে বসা তাদের উচ্ছিষ্টভোগীদের নির্ভেজাল আনুগত্যে এবং দ্ব্যর্থহীন সহযোগিতায়।
আমাদের মনে রাখতে হবে ফিলিস্তিন শুধু দৈর্ঘ্য প্রস্থের এক টুকরো ভূখণ্ড নয়। এটা ঐশী আশির্বাদপুষ্ট এক পূণ্যভূমি যেখানে অধিকাংশ নবীর নীড় ছিলো। যেখান থেকে সবচেয়ে বিস্ময়কর ভ্রমণ ‘মেরাজ’ শুরু হয়েছিল। বিশ্বের আদি-অন্ত রহস্য যেখানে লুকায়িত। যেখানে সময়ের বিভিন্ন স্তরের মোলাকাত হয়। যেখানে জ্ঞানীদের জ্ঞান ও শিল্পীদের শিল্প কর্ম এসে উপনীত হয়। যেখানে লুপ্ত ঐতিহ্য ও গুপ্ত মনীষার অন্বেষা হয়। যেখানে এসে গল্প ও ইতিহাস তাদের বাহন থামায়। যেখান থেকে কেয়ামতপূর্ব পৃথিবীতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। যেখানে মহাপ্রলয়ের আগে মানব জাতির শেষ সম্মিলন হবে সেই পবিত্র ভূমিকে রক্ষা করা আমাদের ঈমানী কর্তব্য। খুব বেশি দূরে নয়, বিশ্বাসীরা তাদের বিশ্বাসের অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে জেরুসালেমের আকাশে আবারো স্বর্গীয় সুখের হিলাল খচিত পতাকা উড়াবে। ইনশাল্লাহ।
লেখক: শিক্ষার্থী, এডুকেশন ফ্যাকাল্টি, ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগ, আল আজহার ইউনিভার্সিটি, মিশর।