ফিলিস্তিনে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ছিলেন তিনি। তাঁর সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব, গোছালো বক্তৃতা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন জনসাধারণের মাঝে। সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে অল্প সময়ে বিক্ষিপ্ত জনতাকে সংগঠিত করে তুলেন এবং সাম্রাজ্যবাদী অপশক্তির অস্তিত্বে আঘাত হানেন সজোরে। ইতিহাসের এই মহানায়ক ১৯৩৬ সালে বৃটিশ সেনাদের হাতে শাহাদাত বরণ করেন। তার শাহাদাতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ফিলিস্তিনে। ফলে যুগ যুগ ধরে মুক্তিকামী জনতার হৃদয়-গভীরে প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছেন তিনি। বলছিলাম গত শতাব্দীর সিরিয়ান ইসলামিক স্কলার ও লেভান্ট অঞ্চলে বৃটিশ ও ফরাসি ম্যান্ডেট শাসনের বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রতিরোধে নেতৃত্বদানকারী ও জায়নবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের আহ্বানকারী এক মহা নায়কের কথা— শাইখ ইজ্জুদ্দীন আল-কাসসাম রাহি.।
তিনি ১৮৮২ সালে সিরিয়ার লাযেকিয়া জেলার দক্ষিণে অবস্থিত জাবালা শহরের একটি সম্ভ্রান্ত দীনি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন৷ তাঁর পিতা আব্দুল কাদির আল-কাসসাম ছিলেন স্বীয় প্রতিষ্ঠিত একটি ধর্মীয় বিদ্যালয়ে পবিত্র কুরআনের শিক্ষক। শাইখ আল- কাসসাম রাহি. মাত্র ১৪ বছর বয়সে ধর্মীয় শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে আপন ভাই ফখরুদ্দীনের সাথে বিশ্ববিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। দীর্ঘ সাত বছর আল আজহারের শীর্ষ আলেমদের সান্নিধ্যে থেকে ইলমে দ্বীনে পাণ্ডিত্য লাভ করে উচ্চ ইজাজাহ (সম্মাননা) নিয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। আল আজহারে তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে অন্যতম হলেন মিশরীয় বিখ্যাত সংস্কারবাদী আলেম বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা মুফতি মুহাম্মদ আব্দুহু রাহ.।
শাইখ আল- কাসসাম রাহ. সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ উপনিবেশকে ফিলিস্তিনের প্রধান শত্রু জ্ঞান করতেন। ইউরোপ হতে ক্রমাগত ফিলিস্তিন অভিমুখী জায়নবাদী শরণার্থী ঢলকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। ইহুদি জনগোষ্ঠীর কাছে ফিলিস্তিনিদের জমি বিক্রির ভয়ংকর পরিণতি সম্পর্কে তিনি সচেতন করেন। এবং শতধা বিভক্ত ফিলিস্তিনি জণগণকে কুরআন সুন্নাহর আলোকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ মোকাবেলার আহ্বান জানান। সাধারণত ফিলিস্তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনগুলি বৃটিশ বিরোধী বিক্ষোভ ও সমাবেশ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিলো। তিনি এর থেকে আগবেড়ে ভাবতেন এবং মনে করতেন যে, ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অবসান এবং ফিলিস্তিনে ইহুদিবাদীরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারোধের একমাত্র সঠিক উপায় ও সমাধান হলো সশস্ত্র বিপ্লব।
শাইখ আল-কাসসাম ১৯০৩ সালে আল আজহার থেকে ধর্মীয় বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা লাভ করে নিজ গ্রামে ফিরে এসে বাবার প্রতিষ্ঠানে হিফজুল কুরআন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। কিছুদিন পর জাবালা শহরের কেন্দ্রীয় মানসুরা মসজিদে ইমাম হিসেবে নিয়োজিত হন। ফলে সম্মোহনী বক্তৃতার জন্যে অল্প সময়ে তাঁর সুনাম সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে দলে দলে মানুষ তাঁর কাছে ভীড় করতে শুরু করে।
১৯১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস তখন। ইতালি আগ্রাসন চালায় লিবিয়ায়। তৎকালীন উসমানীয়-লিবিয়ায় ‘প্রতিরোধ আন্দোলনে’র জন্য ২৫০ সদস্যের একটি সেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন শাইখ আল-কাসসাম। তাঁর নিজ শহর জাবলাতে তহবিল সংগ্রহের প্রচারাভিযান চালান এই সংগঠনের মাধ্যমে। সেই সাথে সাধারণ জনতাকে নিয়ে ইতালির এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। লিবিয়ায় প্রতিরোধ আন্দোলনকে সরাসরি সাহায্য করতে সদলবলে মিশরের আলেক্সান্দ্রিয়া বন্দরেও পৌঁছে যান তিনি। কিন্তু তৎকালীন তুর্কি-খেলাফত সরকার তাঁর সংবদ্ধ যাত্রায় বাধা প্রদান করে।
১৯১৯-১৯২০ সালের দিকে জায়নবাদ বিরোধী বিপ্লবী নেতা উমর আল-বিতারকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে নিজ বাড়িটি বিক্রি করে তিনি আল হাফার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় চলে যান। ১৯২১ সালের জায়নবাদ বিরোধী বিপ্লব ব্যর্থ হলে শাইখ আল-কাসসাম আপন সঙ্গীদের নিয়ে উত্তর ফিলিস্তিনে হিজরত করেন। সেখানে বিপ্লবী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হায়ফার পুরাতন মহল্লার মসজিদ আল ইস্তিকলালকে (স্বাধীনতা মসজিদ) কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন। হায়ফার এই পুরাতন মহল্লায় বসবাস করতো ফিলিস্তিনের আল গ্যালিল ( জালিল) থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া গরীব ভূমিহীন কৃষকরা। শাইখ আল-কাসসাম এই অশিক্ষিত গ্রামবাসীকে নৈশকালীন পাঠদানের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেন। ফলে উত্তর ফিলিস্তিনের কৃষক শ্রেণির কাছে তিনি দ্রুত জনপ্রিয় ও আস্থাভাজন হয়ে উঠেন। হায়ফা থাকাকালীন তিনি একটি ইসলামিক স্কুলে শিক্ষকতা করার জন্য যোগদান করেন। এবং মুসলিম যুব-সমিতি (জামইয়্যাহ শুব্বান আল- মুসলিমিন) প্রতিষ্ঠা করে ১৯২৬ সালে তার নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। সে সময়ে তিনি উত্তর ফিলিস্তিনের কৃষকদের মাঝে ব্যাপকভাবে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জিহাদের দাওয়াহ ছড়িয়ে দিতে থাকেন। তাদেরকে বৃটিশ বিরোধী অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে আহ্বান জানান।
১৯৩২ সালের ফ্রীডম পার্টির (হিজব আল ইসতিকলাল) হায়ফা শাখার সদস্য ফরম পূরণ করে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অনাগত যুদ্ধের অস্ত্র সংগ্রহের তহবিলের জন্য ব্যাপকভাবে প্রচারাভিযানও পরিচালনা শুরু করেন তখন।
শাইখ আল- কাসসাম ফিলিস্তিনের কাফারদান এলাকাকে কেন্দ্র করে দাওয়াতি ও জিহাদি কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকেন। বলতে গেলে এটাই ছিল তাঁর সামরিক, রাজনৈতিক ও দাওয়াতি কর্মযজ্ঞ পরিচালনার সদর দফতর। তাঁর দাওয়াতে সাড়াদানকারীদের মধ্য থেকে অত্যন্ত চৌকশ লোকদের বেছে বেছে ৫ সদস্যবিশিষ্ট কিছু সৈন্যদল গঠন করেন। পরবর্তীতে এই সৈন্যদলগুলো কাতায়েব আল- কাসসাম বা কাসসাম ব্রিগেড নামে বেশ পরিচিতি লাভ করে। শাইখ আল-কাসসাম তখনকার এই ক্ষুদ্র দলগুলোকে বিভিন্ন শাখা উপশাখায় বিভক্ত করে জিহাদের পক্ষে প্রচারাভিযানকারী শাখা, রাজনৈতিক শাখা, গোয়েন্দা শাখা ও সামরিক অভিযান পরিচালনা জন্য প্রশিক্ষণ শাখা ইত্যাদি ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।
১৯৩৫ সালের ১৫ নভেম্বর বৃটিশ সেনারা আল-বারিদ গ্রামে আত্মগোপনে থাকা শাইখের অবস্থান টের পেয়ে গেলে ১৫ জন জানবাজ মুজাহিদসহ শেখ যায়েদ গ্রামে প্রস্থান করেন। কিন্তু নভেম্বরে ১৯ তারিখে বৃটিশ সৈন্যরা তাঁর অবস্থান সম্পর্কে জেনে যায়। তারা চতুর্দিক থেকে শাইখকে ঘিরে ফেলে; ফলে অন্যান্য এলাকার মুজাহিদ বাহিনীর সাথে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বৃটিশ সেনারা শাইখকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। কিন্তু শাইখ আল-কাসসাম তাদের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বীরের মতো লড়াই করার পথ বেছে নেন। তাঁর সঙ্গে থাকা ১৫ জনের দুর্ধর্ষ মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে বৃটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
২০ নভেম্বর দীর্ঘ ৬ ঘন্টার মরণপণ লড়াইয়ে শাইখসহ তাঁর ১৫ জন সঙ্গী শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে মহান রবের সান্নিধ্য লাভ করেন।
শাইখ আল-কাসসামের শাহাদাতের খবর মুহূর্তে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মনে বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে। সেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৩৬ সালে ফিলিস্তিনে বৃটিশ বিরোধী মহাবিপ্লবের সময়ে । এই বিপ্লব পরবতর্তীতে ফিলিস্তিনের মুক্তি সংগ্রামকে আরও বেগবান করে তুলে।